‘দেশের গরীব মানুষও সরু চাল খাচ্ছে, তাই দাম বাড়ছে’
আমাদের দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য হচ্ছে চাল। কিছুদিন থেকেই বেড়েই চলেছে চালের দাম। একটু একটু করে বেড়ে এক মাসের ব্যবধানে চিকন চালের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ৮ টাকা। মোটা চালের দামও বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা। যদিও কৃষক যাতে চালের ন্যায্য মূল্য পায় তার জন্যই দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
আজ রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকায়। যা মাসের প্রথম সপ্তাহেও ছিল ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা। এক মাসের মধ্যেই দাম বেড়েছে প্রায় ৮ টাকা। প্রতি কেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা কেজি। যা এর আগে বিক্রি হয়েছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা কেজি। এছাড়া লতা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা কেজি। যা এর আগে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর বাজারে আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকায় যা আগে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গুটি চালের দাম ৩০ থেকে ৩২ টাকায় পৌঁছেছে।
মিরপুর-২ নাম্বার বাজারে কথা হয় এক চাল ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি বলেন, বড় বড় ব্যবসায়ীরা একটু একটু করে বাড়াচ্ছেন চালের দাম। যাতে সরকারের নজরে না আসে। এর আগে মোকাম থেকে যে চাল নিয়ে এসেছেন তার থেকে প্রায় দেড়শ টাকা বেড়েছে চালের বর্তমান দাম। তবে আগের চাল দোকানে থাকায় একটু কম দামে বিক্রি করছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যেই চিকন চালের দাম কেজি প্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। বাজারের যা অবস্থা দেখলাম তাতে আরও ৩ থেকে ৪ টাকা বাড়বে দাম। তবে মোটা চালের দাম কিছুটা কম বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির হিসেব অনুযায়ী দেখা যায়, এক মাসের মধ্যে প্রতি কেজি সরু চালের দাম বেড়েছে আট থেকে নয় টাকা। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে যেখানে প্রতি কেজি সরু চালের দাম ছিল ৪৫ থেকে ৬০ টাকা। তা আজ বেড়ে হয়েছে ৫৪ থেকে ৬০ টাকা। মাঝারি চালের দাম ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা তা বেড়ে হয়েছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। তবে কিছুটা কম বেড়েছে মোটা চালের দাম। প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ছিল, তা হয়েছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘চালের দাম আরও বাড়া উচিত। কারণ, এত দিন কৃষক ধানের দাম পায়নি। চালের দাম বাড়ার কারণে ধানের দাম বাড়বে। এতে কৃষক লাভবান হবে। মোটা চালের তুলনায় সরু চালের চাহিদা বেড়েছে। এতে মূলত দাম বেড়েছে।’
টিসিবির হিসাবে গত সপ্তাহে প্রতি কেজি সরু চালের দাম ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। গতকাল বৃহস্পতিবার বেড়ে হয়েছে ৫৪ থেকে ৬০ টাকা। মাঝারি চালের দর ছিল ৪২ থেকে ৫০ টাকা। গতকাল তা বেড়ে হয়েছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। তবে মোটা চালের দাম তুলনামূলক কম বেড়েছে। প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ছিল, তা হয়েছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইফপ্রি, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আখতার আহমেদ বলেন, এই সময়ে চালের দাম সাধারণত বাড়ে। কিন্তু এবার সরু চালের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেড়েছে। এটা কেন ঘটল, তা সরকারের অনুসন্ধান করে দেখা উচিত।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) গত নভেম্বর মাসে দেশের চালের বাজারের ওপরে একটি সমীক্ষা করেছে। এতে বলা হয়েছে, ধান–চালের বাজারে ৯৪৯টি অটো চালকল নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। বাজারে কত দামে ধান–চাল বিক্রি হবে, তা ওই বড় চালকলগুলোর ওপর নির্ভর করে। এমনকি চাল আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা প্রধান। এগুলোর মধ্যে ৫০টি চালকল ধান-চালের দাম নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী বলেন, দেশের গরিব মানুষও সরু চাল খাচ্ছে, তাই দাম বাড়ছে। রপ্তানি হলেও দাম বাড়বে না বলে তিনি মনে করেন।
তবে চালের দাম যে হারে বেড়েছে, ধানের দাম সেই হারে বাড়েনি। রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়াসহ দেশের বেশির ভাগ চালের মোকামে ধানের দাম কেজিতে এক থেকে দুই টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোটা ধানের দর কেজিতে ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৬ টাকা হয়েছে। অথচ সরকার ওই ধানের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ২৬ টাকা। আর সরু ধানের দর প্রতি কেজি ২০ টাকা থেকে বেড়ে ২২ টাকা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান বলেন, চালের দাম যখন বাড়ছে, তখন সরকার থেকে রপ্তানির ওপরে প্রণোদনা হিসেবে ভর্তুকি দেওয়ার ঘোষণাটি ঠিক হয়নি। কারণ, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
আমাদের দেশে সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান ও চৈত্র মাসে বোরো ধান ওঠে। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি ও গবেষণা সংস্থা-ইফপ্রি এর তথ্য মতে, আমাদের দেশে কৃষকের কাছে সবচেয়ে বেশি ধান মজুত থাকে এপ্রিল থেকে মে মাসে। এরপর থেকে কৃষকের মজুত ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
গতবছর মে মাসের দিকে দেখা যায়, বাজারে ধানের দাম কম থাকায় কৃষক বিক্রি করতে পারছে না। ধান আবাদ করতে যে পরিমাণ খরচ বিক্রি করতে গিয়ে সে টাকা পাওয়া যায় না। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামে ধান কেনার ক্রেতা পাওয়া যায় না। ফলে কম দামেই কৃষককে তার ধান বিক্রি করে দিতে হয়। এরপর যখন ধান কৃষকের হাত থেকে ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের কাছে চলে যায় তখন আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে চালের দাম। ইফপ্রি’র বিশ্লেষণে এমনটাই উঠে এসেছে। এই সময়ে কৃষকের কাছে ধান নেই অথচ এখন হু হু করে বাড়ছে চালের দাম।