মহিষও দেশের অর্থনীতির চাকা সচলে রাখতে পারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা
নোয়াখালী প্রতিনিধি Channel 4TV :
রৌদ্রের প্রখর তাপদাহ প্রকৃতিকে করে রেখেছে ভীষন অস্থির। এখানে-সেখানে বয়ে যাওয়া খাল-বিল-হাওর সাদা রঙের বকেরা ডানা মেলে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। আবার কখনো কখনো পা ডুবিয়ে শিকার করছে পুঁটি-টেংরা। খালের পাড় ঘেঁষে মহিষের পাল নিয়ে ছুটে চলছে রাখাল ছেলেরা। যা আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপ। শস্য-শ্যামল সোনার বাংলার এমন দৃশ্য খুব কমই চোখে পড়ে।
মহিষের এ অপরূপ দৃশ্যটি জেলার সুবর্ণচর উপজেলাধীন রূপ মাধুর্যের এক স্বপ্নীল রূপায়ন। এ চরের বেশিরভাগ এলাকাই মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে। ফলে প্রকৃতির নিজস্ব বলয় আর স্বকীয়তা এখানকার চরাঞ্চলকে করে তুলেছে উপজীব্য।
অন্যদিকে এখানকার মানুষকে করে তুলেছে সংগ্রামী চেতনায় বলীয়ান। লাঙ্গলের ফলা থেকে উঠে আসা মাটির ঘ্রাণ মানুষকে করে তোরে আন্দোলিত এবং শিহরিত। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান একসময় খুব নি¤œমানের হলেও কালের বিবর্তনে পরিবর্তনের হাওয়া তাদেরকে পাল্টে দিয়েছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়গুলোতে এখানকার চারণভূমিগুলো ছিল নিভৃত ছায়াবেষ্টিত। জনমানবহীন এক ধূ-ধূ বালুচর। নদীর বুক থেকে জেগে ওঠা চরগুলো তখন ছিল বসবাসের অযোগ্য। আস্তে আস্তে কিছু নদীভাঙা ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী যাদের কিনা মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই ছিল না, তারা চরে এখানে-সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে বসতি স্থাপন করেন এবং মাটির বুকে লাঙ্গল চালিয়ে, নোনা মাটিকে ফসল ফলানোর উপযোগী করে সোনালি ফসল ফলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে এক সময় সফল হন।
কৃষি এখানকার মানুষের প্রধান পেশা হলেও পশু পালন এদের আয়ের আরেকটি বড় উৎস। গরু-ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি পালন করে এখানকার নি¤œ আয়ের মানুষগুলো পরিবারের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন। তবে কিছু অবস্থাশালী গৃহস্থরা মহিষ পালন করে নিজেদের অর্থনৈতিক দৈন্যতা দুরীভূত করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। মহিষ পালন মূলতঃ লাভজনক একটি পেশা। চরাঞ্চলের তৃণভোগী পশুর মধ্যে মহিষের মূল্য সবচেয়ে বেশি। এর পালন প্রক্রিয়াটা খুব একটা জটিল নয়। কেননা মহিষের লালন-পালনে বাড়তি খাদ্য কিংবা যতœ খুব একটা প্রয়োজন হয় না। অথচ অন্যান্য পশুর চেয়ে মহিষ পালন সবচেয়ে লাভজনক। একেকটা মহিষের বাজার মূল্য লক্ষাধিক টাকা। যা দু’তিনটি গরুর মূল্যের সমান। মহিষের দুধ থেকে তৈরি দধি, ছানা, মিষ্টি খুবই সুস্বাদু। চরাঞ্চলে যারা আতিথেয়তা গ্রহণ করেন তারা মহিষের দুধের তৈরি উপাদেয় খাদ্যগুলোর স্বাদ-আস্বাদন না করে খুব একটা ফেরেন না। এসব খাদ্য গুণে-মানে ও পুষ্টিতে অতুলনীয় মহিষের পাল যখন চরাঞ্চলের চারণভূমিতে বিচরণ করে, তখন চরের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যতা এক স্বকীয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চরের মানুষের সংস্কৃতির এক অনিবার্য নিদর্শন যেন এই মহিষের পাল। এই বিচিত্র নিদর্শনটি দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় কি-না সন্দেহ আছে। জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে মহিষের একটা নিজস্বতা রয়েছে। কিছু প্রাণীর মতো মহিষকে উভয়চর বললেও খুব একটা ভুল হবে না। কারণ মহিষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে থাকতে ভালোবাসে। এমনিতে শান্ত প্রকৃতির একটি প্রাণী মহিষ। তবে মাঝে মাঝে এই প্রাণীর মস্তিষ্ক অনেক সময় বিকৃত হয়ে গেলে এরা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। এ সময় এর আক্রমণে অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটে থাকে। মহিষ পালনের সাথে জড়িত এমন কয়েকজন গৃহস্থ জানান, মহিষ পালন লাভজনক হলেও অনেক ক্ষেত্রে কিছু বনদস্যু গভীর রাতে এসে মহিষের পাল নিয়ে যায়। এ সময় তাদের কাছে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র থাকার কারণে কিছুই করার থাকে না। আবার গ্রীষ্মের প্রচন্ড- খরার সময় যখন খাল-বিল-হাওর শুকিয়ে যায় তখন প্রচন্ড- তাপদাহে মহিষকে টিকিয়ে রাখা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। তারা আরো জানান, খাল-বিল-হাওরে পর্যাপ্ত পানির ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে এই প্রাণীটি চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকাসহ দেশের অর্থনীতিতে রাখতে পারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। চরঞ্চলের মহিষ পালনের বিষয় নিয়ে কথা হয় জেলা পশু সম্পদ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের সাথে। তিনি বলেন, নোয়াখালীর সূবর্ণচরের চারণভূমিতে মহিষ পালন কয়েকযুগের প্রথা হিসাবে চলে আসছে। এই শিল্পটি এখানকার প্রকৃতিকে করে তুলেছে নান্দনিক ও সৌন্দয্য মন্ডিত। আমরা সরকারি ভাবে পশুপালনের উপর যে কয়টি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি তার মধ্যে মহিষ পালনের বিষয়টি একটি অন্যতম কর্মসূচি। এই শিল্পের সাথে জড়িত জনসাধারনকে আমরা চেষ্টা করি দক্ষ এবং অভিজ্ঞ করে তুলতে।