জনসম্মুক্ষে ঝাড়ু দিয়ে নগরবাসীকে ধুলা খাওয়াচ্ছে রাসিক
নিজস্ব প্রতিবেদক:
শনিবার রাত আটটা। রাজশাহী নগর ভবনের প্রাচীরের সঙ্গে বসার স্থানে বসে আছে জনা ত্রিশেক মানুষ। যাদের মধ্যে যুবক-যুবতীর সংখ্যা বেশি। তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী বলেই মনে হলো। তারা সবাই বসে আড্ডায় ব্যস্ত। আবার জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থেকেই গল্পে ব্যস্ত ছিলেন। পশেই রাস্তার ওপর ফেরি করে ফাস্টফুড বিক্রি করছিলেন তিনজন ব্যবসায়ী।
এছাড়াও একজন বিক্রি করছিলেন মুড়ি ও চানাচুর ভাজা। ঠিক ওইসময় একজন নারী রাস্তা ঝাড়ু দিতে দিতে নগর ভবনের পূর্বদিক থেকে আসছিলেন পশ্চিম দিকে। জনসাধারণের ওই অড্ডাস্থলের কাছাকাছি রাস্তার ঝাড়–দার পরিচ্ছন্নতাকর্মী আসতেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ধুলা। এতে করে চরম অশ্বস্তিতে পড়েন আড্ডাস্থলের ওই লোকজন। এছাড়াও পাশেই ফাস্টুফুডের ফেরি দোকানগুলোতে রাখা খাবারেও গিয়ে পড়তে থাকে ধুলা।
এমন দৃশ্য শুধু ওইদিনের নয়। এটি প্রতিদিনের অবস্থা। এই অবস্থা শুধু নগর ভবনের সামনেই নয়। প্রধান শহরের দৃশ্যই এটি। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে ঝাড়–দার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ঝাড়ু হাতে নামেন রাস্তায়। আর তাঁদের ঝাড়ুর আঘাতে রাস্তার ধুলাগুলো উড়তে থাকে থাকে চারিদিকে। সেই সঙ্গে ধুলাগুলো পড়তে থাকে রাস্তার ওপরে বা ফুপপাতে এবং রাস্তার পাশের বিভিন্ন খাবারের দোকানগুলো থেকে শুরু করে আশে-পাশের ঘরবাড়িতে।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দিয়ে এভাবে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষকে ধুলা খাওয়াচ্ছে রাসিক। অথচ পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের রাত সাড়ে নয়টার পর থেকে রাস্তায় ঝাড়– দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটি না করে সন্ধ্যা নামার পর পরই প্রতিদিন ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নামেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এর ফলে ধুলায় ব্যাপক ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় পথচারীসহ সাধারণ মানুষকে।
বিশেষ করে যারা শ্বাসকষ্ঠ এবং এলার্জি সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত তারা পড়েন বেশি ভোগান্তিতে। উড়ে আসা ধুলায় আক্রান্ত হয়ে অনেকের সঙ্গে সঙ্গে হাঁচি ও কাশি শুরু হতে দেখা যায়। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ রয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় মেয়রসহ রাসিকের পরিচ্ছন্নতা দপ্তরেও একাধিক অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তাদের ইচ্ছেমতোই রাস্তা পরিস্কারে নামেন।
রাসিক সূত্র মতে, রাজশাহী নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ঝাড়ুদার রয়েছে ১৮৬। এর বাইরে ওয়ার্ড পর্যায়ে রয়েছে আরো ২৯৩ জন। যাদের পরিচ্ছন্ন কাজ শুরু করার কথা রাত সাড়ে ৯ টার পর থেকে। কিন্তু রাজশাহী নগরীতে এখন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা শুরু হয় রাত আটটা বাজতে না বাজতেই।
নগরীর দরিখরবোনা মোড়ের চা ব্যবসায়ী সেলিম হোসেন জানান, তাঁদের মোড়ে অন্তত রাত ১১টা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের আড্ডা থাকে। কিন্তু সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা ঝাড়–দারদের কারণে এসব মানুষকে প্রতিদিন ধুলা খেতে হচ্ছে। ধুলা এসে পড়ছে চায়ের কাপ থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের বিভিন্ন খাবারের দোকানগুলোতেও। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কিছু করার নাই। ব্যবসায়ীরা এই সময়ে রাস্তায় ঝাড়ু না দিতে বার
বার আবেদন জানিয়েছেন রাসিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। বরং প্রতিদিন একইভাবে রাস্তায় ঝাড়– দেওয়া হচ্ছে।
নগরীর কাদিরগঞ্জের আরেক হোটেল ব্যবসায়ী পান্না বলেন, সন্ধ্যার পর পরই গরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে ঝাড়– দেওয়া শুরু হয় বলে পথচারীসহ রাস্তার পাশের ক্রেতা-বিক্রেতাদের পড়তে হয় ব্যাপক ভোগান্তিতে। বিশেষ করে উড়ে আসা ধুলায় মানুষের শরীর মেখে যাওয়াসহ নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে যায়। আবার দোকান-পাটগুলোতেও দ্রুত ময়লা জমে।
সরেজিমন ঘুরে দেখা গেছে, সন্ধ্যার পর পরই রাস্তায় ঝাড়– দেওযার কারণে ভোর হওয়ার আগে আগেই নগরীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে আবারও ময়লা-আবজর্ন জমে নোংরায় পরিণত হয়। অথচ আগে ভোরবেলা এই সড়কগুলো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হতো বলে উড়ে আসা ধুলা থেকে সাধারণ মানুষ রেয়াই পেতেন। কারণ ওই সময় রাস্তায় খুব একটা জনসাধারণকে চলাচল করতে দেখা যায় না। আবার ওই সময় নগরীর প্রায় ৯৯ ভাগ দোকান-পাটই বন্ধ থাকে বলে উড়ে আসা ধুলা থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রক্ষা পায়।
অন্যদিকে ভোরে রাস্তার পরিস্কার করলে বেলা ১১টা পর্যন্ত সড়কগুলো পরিস্কার থাকতো। কিন্তু এখন যেমন ভোর হওয়ার আগেই নগরীর রাস্তাগুলো ময়লা এবং ধুলা-বালির ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে, তেমনি সারাদিনই থাকছে একই অবস্থা। আবার সন্ধ্যার পরপরই নগরীবাসীকে ধুলা খেতে হচ্ছে।
অপরদিকে সন্ধ্যার পর পরই নগরীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে পরিচ্ছন্নতা কাজ শুরু হয় বলে, ওই সময় চলাচলকারী যানবাহনের ভীড়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও হুমকির মুখে থাকেন। সেইসঙ্গে নানামুখি সমস্যার কারণে সন্ধ্যার পরপরই নগর পরিচ্ছন্নতা কাজ নিয়ে শুরু থেকেই নগরবাসী আপত্তি তুলে আসলেও এটি কানে নিচ্ছে না নগর সংস্থা। ফলে ২০০৯ সাল থেকেই এভাবে সন্ধ্যার পরপরই নগরীর সড়ক পরিচ্ছন্নতার নামে ধুলা খাওয়ানো হচ্ছে নাগরিকদের।
রাসিক সূত্র মতে, রাজশাহীর বিভিন্ন সড়ক পরিস্কারের কাজের তদারকির জন্য সুপারভাইজার রয়েছেন ৫০ জন। এই সুপারভাইজাররা দেখভাল করেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। কিন্তু সবাই ইচ্ছুক নিজের সুবিধামতো কাজ করতে। কেউ কাজ করে দিনে আর কেউ রাতে। প্রতিদিন ঠিকই শহর পরিচ্ছন্ন করার কাজ করা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ে কেউ কাজ করেন না। তাই সঠিক পর্যবেক্ষণ আর তদারকির অভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবেই চলছে শহর পরিচ্ছন্নতা।
নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা কাজী আহসান বলেন, ‘রাস্তায় ঝাড়– দেয়া উচিৎ রাত গভীর হলে অথবা ভোরে। যখন রাস্তায় কোন মানুষ থাকবে না। কিন্তু রাস্তায় সাধারণ মানুষের চলাফেরা, যানবাহন যাওয়া আসার ভিতরেই ঝাড়– দেওয়া হচ্ছে। এতে করে ধুলার শহরে পরিণত হচ্ছে রাজশাহী।
সোনাদিঘী মোড়ের হোটেল ব্যবসায়ী বলেন আবুল হোসেন বলেন, এখন আর সন্ধ্যার পরে হোটেলে কিছু তৈরী করায় যায় রাস্তার ধুলার কারণে। খদ্দেরও আসতে চায় না। এ নিয়ে বারবার সিটি করপোরেশনে অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয়নি।
জানতে চাইলে নগরীর প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মামুন ডলার বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য মানুষকে সকালে উঠেই একটি ক্লিন সিটি দেখানো। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য হয়তো পূরণ হচ্ছে না নানা কারণে। তবে এসব সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যায়, তা ভেবে দেখা হবে।’