বদলগাছীতে কেঁচো চাষে ভাগ্য পাল্টিয়েছে অভাবী এক দম্পতির জীবন সংসার
জয়পুরহাট প্রতিনিধিঃ নিরেন দাস।
জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার শেষ সীমানা নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার কোঁলা ইউপির আক্কেলপুর আক্কেলপুর থানার কামারপাড়া গ্রামের ষাটোর্দ্ধ দম্পতি আকবর আলী ও স্ত্রী মিনি আরা।
যাদের সংসার জীবনে ছিলো একটি মেয়ে আর একটি ছেলে যারা আজ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসার জীবনে পাঠিয়েছে এবং সাথে তারা বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়ে আলাদা করেও দিয়েছেন।
খবরাখবর সূত্রে জানা যায় তাদের বাপদাদার পৈত্রিক সূত্রে তিন বিঘা জমি পেয়েছেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিয়েছেন। তবে দম্পতির এ গল্প দুই বছর আগের। কেঁচো সার এখন ভাগ্য বদলে দিয়েছে এই দম্পতির। এই সার তৈরি করে তারা এখন মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা বাড়তি আয় করে থাকেন। সামান্য জমি আর দুইটি গরুর দুধ বিক্রি করে যখন এ দম্পতির দিন কাটত অনাহারে-অর্ধাহারে তখন কেঁচো সার তৈরি করার পরিকল্পনা দেয় মিনি আরার ছোট ভাই।
আর এ বিষয়ে পরামর্শ নিতে স্থানীয় কৃষি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শে সামান্য কিছু কেঁচো সংগ্রহ করে মাত্র চারটি চাঁড়িতে (এক ধরনের মাটির পাত্র) সার তৈরির কার্যক্রম শুরু করেন। ফলাফল ভাল আর লাভজনক হওয়ায় বাড়তে থাকে তাদের সার তৈরির কার্যক্রম। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এখন তাদের চাঁড়ি দাড়িয়েছে ১৫০টি। এমনকি বাড়ির আঙ্গিনা, বারান্দার পাশাপাশি শোবার ঘরেও রেখেছেন কেঁচো সারের চাঁড়ি। প্রতি চাঁড়ি হতে সার তৈরি হয় ৫ হতে ৬ কেজি। নিজের জমিতে ব্যবহার বাদে প্রতি কেজি সার বিক্রি করেন ১৫ হতে ১৬ টাকা কেজি দরে। স্থানীয় কীটনাশক ও সার ব্যবসায়ীরা এ সার পাইকারী নিয়ে যান।
আবার অনেক কৃষক সরাসরি তাদের কাছ থেকেও সার কিনেন। এতে এ দম্পতির শুধু মাত্র কেঁচো সার বিক্রি করেই মাসে বাড়তি আয় হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আর তাদের দেখাদেখি এখন কেঁচো সার তৈরিতে আগ্রহ বাড়ছে এলাকার কৃষকের মধ্যে। অনেকেই উদ্যোগ নিচ্ছে কেঁচো সার তৈরির জন্য।
কেঁচো সার তৈরি করতে বেশি বেগ পেতে হয়না তাদের। কেঁচো সার তৈরির প্রধান কাঁচামাল গোবর (গরুর বিষ্ঠা)। বাড়িতে তিনটি গাভী গরু আছে। গরুগুলো সবসময় বাঁধা থাকে। সেখানে গরুর পরিচর্যা করা হয়। কেঁচো সার তৈরিতে প্রথমে গোবরকে বালু ও আবর্জনা মুক্ত করে ছায়াযুক্ত স্থানে গোবরগুলো স্তুপ আকারে ১২ থেকে ১৫ দিন রাখতে হবে। এসময়ের মধ্যে গোবর থেকে গ্যাস বেরিয়ে যায় এবং কালচে রং ধারণ করে। এরপর ওই গোবর চাঁড়িতে দিয়ে সংগৃহীত কেঁচো তার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। ছায়াযুক্ত স্থানে চাঁড়িটি রেখে দিলে সার তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়। ভাল ফলাফলের জন্য মাঝে মাঝে গোবরগুলো উলোটপালট করে দিলে ভাল হয়। আর কেঁচো যেন ইঁদুর বা অন্য কিছুতে খেয়ে ফেলতে না পারে সেজন্য কোন কিছু দিয়ে চাঁড়ি ঢেকে রাখলে আরও ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। ১৫ থেকে ২৫ দিন পর গোবরগুলো সার হয়ে গেলে নেট চালিয়ে কেঁচোগুলো আলাদা করে সার বের করে নিতে হবে।
এই সার বেগুন, লাউ, আদা, হলুদ, সীম, মরিচসহ যে কোন ধরনের ফসলে ব্যবহার করা যায়। এতে ফসলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায় এবং রাসায়নিক সার খুবই সামান্য পরিমান লাগে। উপজেলার পার-আধাইপুর গ্রামের কৃষক মাজেদুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, দশ কাঠা লাউয়ের জমিতে কেঁচো সার ব্যবহার করে আমি চমৎকার ফলাফল পেয়েছি। রাসায়নিক সার তো তেমন লাগেনি আর লাউ হয়েছে অনেক বড় বড়। আকবর ভাইয়ের এই উদ্যোগটি খুবই ভাল উদ্যোগ। আমিও কেঁচো সারের একটি খামার করব বলে ভাবছি।
এ আকবর-মিনি দম্পতি আরো বলেন, কেঁচো সার আমাদের জীবনের একটি সৌভাগ্য । এই সারের কারণে আমার নিজের জমিতে ফসল করতে তেমন টাকা খরচ হয় না। এখান থেকে উর্পাজিত অর্থের কারণে সংসার চালাতে আর কারো নিতে হয় না তাদের।
স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, প্রথমে সামান্য কিছু কেঁচো সংগ্রহ করে দিয়ে কিভাবে সার তৈরি করতে হয় সেটা আমি আকবর আলী ও মিনি আরাকে শিখিয়ে দিয়েছি। এভাবেই ওদের সার তৈরির যাত্রা শুরু। তিনি আরও বলেন তবে আমি মাঝেমধ্যে এসে খোঁজ নেই এবং কোন সমস্যা হলে পরামর্শ দিই। তবে এখন ওরা আমার চেয়েও এ বিষয়ে বেশী অভিজ্ঞতা বেড়ে গিয়েছে।
বদলগাছী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা,মোঃ হাসান আলী বলেন, বর্তমানে রাসায়নিক সার ব্যবহার করার কারণে মাটি দিন দিন তার গুনাগুন হাড়িয়ে ফেলছে। সে কারণে পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতির মধ্যে কেঁচো সার সময় উপযোগি পদ্ধতি। আমরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং আমাদের উপ-সহকারীরা সব সময় এবিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছে।
এবং সেই জন্য অনেক কৃষকই এখন কেঁচো সার তৈরিতে আগ্রহী হচ্ছে।