বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৪ তম জন্মদিন আজ (১০ আগস্ট)
এস এম আলমগীর কবির, নড়াইল
বিশ্ববরেণ্য চিত্র শিল্পী অসংখ্য দুর্লভ চিত্রকর্মের অমর কারিগর এসএম সুলতানের আজ (১০ আগস্ট) ৯৪তম জন্মদিন। মানবপ্রেমিক এই মহান শিল্পী ১৯২৩ সালের ১০ আগষ্টে যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মাছিমদিয়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর বাবার নাম শেখ মোহাম্মদ মেছের আলী। তিনি পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। মায়ের নাম মাজু বিবি। পরিবারের সবাই তাকে লাল মিয়া বলে ডাকতেন। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে রাজমিস্ত্রির কাজে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ছবি আঁকার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল তাঁর। তিনি কিংবদন্তি ও চারুকলার ইতিহাসে সত্যিই এক সুলতান।
তাঁর ছবির প্রধান বিষয় হল গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ, কিষাণ- কিষাণী, জেলে-জেলেনী, মাঠ-ঘাট, কর্মচঞ্চল পথ-প্রান্তরসহ গ্রামীণ জনপদের অসংখ্য চিত্র শিল্পীর রঙ-তুলিতে উঠে এসেছে সুনিপুণভাবে। আবহমান বাংলার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তাঁর শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। এই অর্থে তিনি প্রকৃত বাঙালী শিল্পী।
লাল-মিয়া ১৯২৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৩৩ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন তাঁদের স্কুলে আসেন শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী। তিনি তাঁর একটি ছবি এঁকে সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন। তিনি চারুকলার উপর পড়াশোনা করার জন্য কলকাতা যেতে চাইলে তাঁর পরিবার রাজি হয়নি। কিন্তু স্থানীয় জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়বাহাদুরের সহযোগিতায় এই বিস্ময়কর প্রতিভাবান শিল্পী ১৯৩৮ সালে কলকতায় চলে যান।
একাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কলকাতা আর্ট স্কুলের গভনির্ং বডির সদস্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে র্আট স্কুলে ভর্তি হন। তিনি লাল মিয়ার নতুন নাম রাখলেন শেখ মুহম্মদ সুলতান সংক্ষেপে এসএম সুলতান। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার সরকারী আর্ট ইনস্টিটিউটের (বর্তমানে সরকারী চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়) চিত্রকলার শিক্ষা গ্রহণ করেন।
সমাজসেবামুলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য সুলতান ১৯৪৩ সালে ‘খোকসার’ আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৪৬ সালে নতুন জীবনের সন্ধান পেলেন সুলতান। মিসেস হাডসন নামে কানাডীয় এক মহিলার উদ্যোগে ভারতের শিমলায় তাঁর একক চিত্র প্রদর্শিত হলো।
এই প্রদর্শনীই তাঁর শিল্পীজীবনের প্রথম স্বীকৃতি। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের লাহোর এবং করাচীতে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে তাঁর মোট বিশটি একক প্রদর্শনী হয় ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনের আয়োজনে চিত্রশিল্পীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত সেমিনারে যোগদান করেন এস এম সুলতান।
১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারী ফোর্ড ফাউন্ডেশনের হাউস মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, মিশিগান, শিকাগো বোস্টনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে এসএম সুলতানের ১৭টি একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। সুলতান নাড়ির টানে ১৯৫৩ সালে ইউরোপ থেকে আবার নড়াইলের মাটিতে ফিরে এলেন। কিন্তু মাছিমদিয়ায় তাঁর পৈত্রিক নিবাস অন্যের দখলে। নড়াইল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত চাঁচুড়ী পুরুলিয়ায় মামার বাড়িতে চলে এলেন সুলতান।
এখানে পুরুলিয়া গ্রামে কৈলাস ঠাকুরের জঙ্গলাচ্ছাদিত, পরিত্যক্ত সর্প আশ্রিত ভুতুড়ে প্রাচীন বাড়ীটিতে কিছু উৎসাহী লোকের সাহায্যে সংস্কার সাধন করেই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নন্দন কানন - দি স্কুল অব ফাইন আর্টস’ এবং এর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে প্রাথমিক শিক্ষাদানের পাঠক্রম। চাঁচুড়ী-পুরুলিয়া থেকে যশোরে চলে এসে তিনি চাঁচড়া রাজবাড়ীতে ‘ইন্টেলেকচার কলোনী’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
১৯৭৩ সালে তিনি ‘চারুকুঠি’ নামে যশোরে একটি (চারুকলা) ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৯ এ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নড়াইল কুড়িগ্রাম ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউশন’। ঢাকার সোনার গাঁয়েও তিনি একটি আর্টস স্কুল খুলেছিলেন। যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনে ‘দি একাডেমী অব ফাইন আর্টস’ নামে একটি চিত্রকলার স্কুল খোলেন। ১৯৮২ সালে সুলতান লাভ করেন একুশে পদক। সুলতানের শেষ জীবনে এসে শিশুদের বিনোদনের জন্য প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি প্রমোদ তরী। শিল্পী এর নাম দেন ‘বজরা।
’ সুলতান শিশুদের নিয়ে প্রায়ই বজরায় চড়ে চিত্রানদীর দু’পাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি আঁকা শেখাতেন। ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবস পদকে ভূষিত হলেন এস এম সুলতান। অবশেষে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তাঁর অতিআদরের শিশুস্বর্গের শিশুদেও ও পোষ্য পশু-পাখিদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এসএম সুলতান।
তার জন্মস্থান নড়াইলের মাছিমদিয়ায় তাকে শায়িত করা হয়।
কর্মসূচী, আজ শুক্রবার (১০ আগস্ট) শিল্পীর জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এসএম সুলতান ফাউন্ডেশন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সুলতান সংগ্রহশালা চত্বরে সকাল ৬টায় কোরআনখানি, ৭টায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, ৮টায় শিল্পীর কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সোয়া ৮টায় শিশুস্বর্গ মিলনায়তনে আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল ও পুরষ্কার বিতরণের আয়োজন করা হয়েছে। সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, ‘শিল্পীর ৯৩তম জন্মবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।