লোহাগড়া প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বেপরোয়া বদলি বাণিজ্য
এস এম আলমগীর কবির নড়াইল প্রতিনিধি
দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন, সেখানে বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আকবর হোসেন। জড়িয়ে পড়েছেন অনিয়ম, ঘুষ আর দুর্নীতিতে।
লোহাগড়ায় যোগদানের পর থেকেই এই সরকারি কর্মকর্তা প্রাথমিক শিক্ষকদের নানা সমস্যাকে পূজি করে ধুন্ধুমার উৎকোচ বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষক বদলীকে কেন্দ্র করে তিনি অফিস সহকারি ইলিয়াস হোসেনের মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষক বদলী বানিজ্যের ঘটনাটি ফাঁস হওয়ার পর ওই কর্মকর্তাসহ তার সহযোগী ইলিয়াস বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের নিকট দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ গ্রহণের বিনিময়ে বিধিলংঘন করে শিক্ষক বদলির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বদলির নিয়ম-নীতি না মেনে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের বাদ দিয়ে জুনিয়র ও নবীন শিক্ষকদের বদলি, পদায়ন করায় ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতাধিক সিনিয়র শিক্ষক। এ ব্যাপারে তারা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে লিখিত ভাবে আবেদন করে বদলি-পদায়ন বাতিল চেয়েছেন।
লোহাগড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ মার্চ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস লোহাগড়া উপজেলার ১৬ জন সহকারী শিক্ষককে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বদলির অনুমতি দিয়ে অফিস আদেশ জারি করা হয়। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বদলির খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ সিনিয়র শিক্ষকেরা ওই দিনই উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে বদলির আবেদনপত্র জমা দিতে গেলে নানা অজুহাতে তা গ্রহণ করেনি উপজেলা শিক্ষা অফিসার।
বদলি প্রত্যাশী জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, শিক্ষা কর্মকর্তা নীতিমালা অনুযায়ী সাত দিন আগে আবেদন জমা দেওয়ার কথা বললেও কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই জুনিয়র শিক্ষকদের বদলি করেছেন, আমরা নিয়ম জানতে গেলে আমাদেরকে বিভাগীয় মামলা দিয়ে চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। শিক্ষা কর্মকর্তাকে এ সব অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করেছেন অফিস সহকারী ইলিয়াস হোসেন।
অভিযোগের ভিত্তিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার মরিচপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন ভাবে বদলিকৃত অঞ্জনা খানম ২০১০ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। একই বিদ্যালয়ে বদলির আবেদনকারী মাহাবুবা খানমের যোগদান ২০০৯ সালে হলেও মাহাবুবার আবেদন উপেক্ষা করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অঞ্জনাকে বদলি করা হয়েছে। মাহাবুবার অভিযোগ, শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী ইলিয়াছ হোসেন তার স্বামীর কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করেছিল, দাবিকৃত টাকা না দেওয়ায় আমার আবেদন গ্রাহ্য করা হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে শূন্য পদ সমূহে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই অর্থের বিনিময়ে গোপনে আবেদন সংগ্রহ করে নিয়ম বর্হিভূত ভাবে শূন্য পদে পদায়ন করা হয়েছে। কেবলমাত্র জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনই নয়, পদ শূন্য না হলেও শিক্ষকদের সুবিধামতো বদলি করে অর্থবাণিজ্য করেছেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। দিঘলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফসিয়ার রহমানকে ঝিকিড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং লাহুড়িয়া পচাশিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সহকারী শিক্ষক অর্পনা বিশ্বাসকে দিঘলিয়া সরকারি প্রাাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই দুটি স্কুলে কোনো পদই শূন্য হয়নি।
এ ছাড়া নীতিমালা লঙ্ঘন করে মতিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দুজন, গোপালপুর সরকারি প্রাাথমিক বিদ্যালয় থেকে দুজন এবং নালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনজন শিক্ষককে বদলি করা হয়েছে। এসব স্কুলে এখন তিনজন করে শিক্ষক রয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কমপক্ষে চারজন শিক্ষক থাকার কথা।
না প্রকাশ না করার শর্তে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, এই অফিসে বদলির বিষয়ে কিছু বললে আমাদের নানা ধরনের ঝামেলায় ফেলার হুমকি দেয় কর্মকর্তারা, তাই চুপ করে সব সহ্য করতে হয়। শিক্ষা অফিসের প্রতিটি কাজেই ঘুষ প্রদান করতে হয়।
মরিচপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সালাউদ্দিন আরিফ বলেন, লোহাগড়া উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী ইলিয়াস হোসেনের মাধ্যমে ৩১ মার্চ রাতে উৎকোচ গ্রহণ করে ১৬ জন শিক্ষকের বদলি চূড়ান্ত করেন ওই শিক্ষা কর্মকর্তা। প্রতিনিয়তই এই অফিসে বদলি বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
লোহাগড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও চাচই সরকারি প্রাাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মফিজুর রহমান গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের অসাধু কর্মচারীরা প্রতিনিয়ত নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঘুষ এর মাধ্যমে বদলি বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। এ সব অনিয়ম দেখার কেউ নেই!
অভিযুক্ত অফিস সহকারী ইলিয়াস হোসেন বদলির ব্যাপারে শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, বদলির ব্যাপারে স্যারেরা ভালো জানেন, আমি অফিস সহকরী হিসেবে কাজ করেছি মাত্র।
এ বিষয়ে লোহাগড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আকবর হোসেন এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
বদলি বাণিজ্যের ব্যাপারে সোমবার দুপুরে গণমাধ্যম কর্মীদের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মু. শাহ আলম বলেন, শিক্ষকদের অভিযোগ আমলে নিয়ে জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হেমায়েত আলী শাহকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অনিয়ম পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।#