প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের ১২ বছর বয়সী ছেলেকে হত্যা করে বাবা
প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের ১২ বছর বয়সী ছেলেকে হত্যা করানোর অভিযোগ উঠেছে বাবার বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত বাবার নাম জাহিদ ওরফে জাহাঙ্গীর (৪০)। বাড়ি সুনামগঞ্জে।
রাজধানীতে গত বছরের ১৭ এপ্রিল বাড্ডার সাতারকুল এলাকায় খুন হয় শিশু আউসার (১২)। এই খুনের ঘটনা তদন্ত করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে সম্প্রতি দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। তাঁরা হলেন আউসারের বাবা জাহিদ ওরফে জাহাঙ্গীর ও জাহিদের আত্মীয় আবদুল মজিদ (২৭)। দুজনই এখন কারাগারে।
কীভাবে আউসার খুন হয়, কেন তাকে খুন করা হয়, সে ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আদালতকে দিয়েছে পুলিশ। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, খুনের প্রধান পরিকল্পনাকারী বাবা জাহিদ। প্রতিপক্ষ হেলাল উদ্দিনকে ফাঁসানোর জন্য মজিদকে দিয়ে আউসারকে খুন করান তিনি।
অথচ আউসার খুন হওয়ার পর জাহিদ বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় খুনের মামলা করেন। সেই মামলায় জাহিদ বলেন, হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে পারিবারিক বিরোধ থাকায় তাঁর লোকজন আউসারকে খুন করতে পারে। কিন্তু খুনের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে বাড্ডা থানার পুলিশ জানতে পারে, জাহিদ নিজেই ছেলে আউসারকে খুন করিয়েছে। পরে পুলিশ বাদী হয়ে জাহিদ ও মজিদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করে।
ছেলেকে কেন খুন করায় জাহিদ
আসামি জাহিদ পেশায় অটোরিকশাচালক। অপর আসামি মজিদ নিরাপত্তারক্ষী। দুজনে থাকতেন সাতারকুল এলাকায়। একই এলাকায় থাকেন চা দোকানদার হেলাল উদ্দিন। জাহিদ যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, তার পাশেই ছিল হেলালের চায়ের দোকান।
আউসারকে কীভাবে খুন করা হয় তা বিস্তারিত বর্ণনা আদালতের কাছে তুলে ধরেন প্রধান আসামি মজিদ। ঢাকার আদালত তাঁর স্বীকারোক্তি রেকর্ড করেন।
মজিদের ১৬৪ ধারার ভাষ্য অনুযায়ী, বাড্ডা এলাকার একটি পোশাক কারখানায় তিনি নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে চাকরি করতেন। আউসারকে হত্যা করার পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে জাহিদ তাঁর অফিসে আসেন। তাঁকে জানান, চা দোকানদার হেলাল উদ্দিন সন্দেহ করেন, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে জাহিদের সম্পর্ক আছে। যে কারণে হেলাল তাঁকে হুমকি দিচ্ছেন। হেলাল উদ্দিনের অত্যাচার থেকে বাঁচতে মজিদের সাহায্য চান তিনি। তখন আউসারকে খুন করে হেলালকে ফাঁসানোর পরিকল্পনার কথা মজিদকে জানান জাহিদ। জাহিদ তাঁকে (মজিদ) আরও জানান, ছেলেকে খুন করে সব দায় চাপাবেন হেলালের ওপর। অবশ্য মজিদের দাবি, প্রথমে এ প্রস্তাবে তিনি জাহিদের কথায় রাজি হননি। পরে অবশ্য রাজি হন। কারণ, জাহিদ তাঁকে টাকার লোভ দেখান। আউসারকে খুন করলে এক লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। টাকার লোভে জাহিদের কথায় রাজি হয়ে যান মজিদ।
মজিদ আদালতকে বলেন, জাহিদের ছেলে আউসার পূর্বাচল এলাকায় রিকশা চালায়। খুন করার জন্য পূর্বাচল থেকে আউসারকে ডেকে তাঁর (মজিদ) কাছে দেয়। প্রথম দফায় সাতারকুলে আউসারকে রিকশায় করে নিয়ে যান। কিন্তু সেদিন আউসারকে তিনি খুন করেননি। ছেড়ে দেন। পরে জাহিদকে তিনি বলেন, আউসার তাঁর কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। পরে জাহিদ আবার তাঁকে বলেন, আউসারকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আউসারকে আবার মজিদের হাতে তুলে দেন। জাহিদ আবার সাতারকুলের একটি মসজিদের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে মজিদ সেদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে আউসারকে নিয়ে যান বাড্ডার আলীর মোড় এলাকায়। সেখান থেকে রহমতউল্লাহ গার্মেন্টসের সামনে আউসারকে নিয়ে আসেন। আউসারকে পরে নিয়ে যান সাতারকুলের পূর্ব পদরদিয়া এলাকার একটি ধানখেতে। জাহিদও তাঁর পেছন পেছন আসতে থাকেন। আউসার অবশ্য তাঁর বাবাকে দেখতে পায়নি। তখন রাত সাড়ে ১০টা। আউসারের সঙ্গে তিনি গল্প করছিলেন। একপর্যায়ে আউসারের গলায় ছুরি দিয়ে আঘাত করেন মজিদ। ঘটনাস্থলেই আউসার মারা যায়। তারপর আউসারের লাশ ধানখেতে রেখে তিনি চলে যান। যে ছুরি দিয়ে আউসারকে খুন করা হয়, সেই ছুরি কেনার টাকা মজিদকে দেন জাহিদ।
প্রধান আসামি মজিদ আদালতের কাছে যে বর্ণনা তুলে ধরেন, প্রায় একই রকম তথ্য আদালতকে জানান শিশু আউসারের বাবা জাহিদও। জাহিদও আউসারকে খুন করার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।
জাহিদের স্বীকারোক্তি বলছে, চা দোকানদার হেলাল তাঁকে সন্দেহ করতেন। হেলালের ধারণা, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আছে। এ নিয়ে হেলাল নানাভাবে তাঁকে ভয়ভীতি দেখান। হেলালের অত্যাচারে তিনি এলাকায় থাকতে পারছিলেন না। এলাকা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দেন। তখন তিনি পরিকল্পনা করেন, নিজের ছেলে আউসারকে খুন করবেন। খুনের দায় দেবেন হেলালের ওপর। তাতে হেলালের মুখ বন্ধ হবে। হেলালের কাছ থেকে চার–পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে ছাড়বেন। নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী মজিদকে দিয়ে ছেলে আউসারকে তিনি খুন করান।
জবানবন্দিতে জাহিদ বলেন, ‘মজিদকে আমি বলি, আমি আমার ছেলে আউসারকে মেরে ফেলব। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।’
এ বিষয়ে বাড্ডা থানার তৎকালীন ওসি (বর্তমানে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, চা দোকানদার হেলালকে ফাঁসানোর জন্যই জাহিদ নিজের ছেলে আউসারকে খুন করায়। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য মামলাও করেন। তবে ঘটনার তদন্তে গিয়ে রাস্তার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার একটা ভিডিও ফুটেজ হাতে পান। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে শিশু আউসার খুনের প্রকৃত রহস্য। জাহিদ নিজের ছেলে আউসারকে খুন করান মজিদকে দিয়ে।