হারিয়ে যাচ্ছে মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের বিখ্যাত সাদা ধবল গরু।
রুবেল মাদবর, মুন্সীগঞ্জ
মিরকাদিমের কুলুপাড়া ধবল গরু পালন করার ঐতিহ্য ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। ২০০ বছরের এই ঐতিহ্য এখন হারানোর পথে। সরকারিভাবে খামারি তৈরী করা এবং এদের পৃষ্ঠপোষন করলে পুনরায় এই ব্যবসায় জৌলুস আসতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
কালের বিবর্তনে মিরকাদিম পুরনো জৌলুস হারালেও মানুষ এখনও সেই বন্দরের স্মৃতি খুঁজে বেড়ায়। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই রাজসিক একটি ভাব আছে এখানকার মানুষের মধ্যে। ইতিহাসের পরম্পরায় তারা কোনো না কোনো ঐতিহ্য লালন করে চলেছে । তেলের মিল, বহু চালের মিল ছাড়াও এখানে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের পুরনো ঐতিহ্যটাকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু মিরকাদিমের বিখ্যাত সাদা ধবল গরুর ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে দিনে দিনে।
সেখানে ৮মাস দীর্ঘ পরিশ্রম করে লাভবান না হওয়ায় এ ব্যবসা থেকে সরে আসছে মিরকাদিমের ধবল গরু ব্যবসায়ীরা। ভেজাল খাদ্যের যোগান দিয়ে গরু বড় করে দ্রুত লাভবান হওয়ার হাতিয়ারকে এখন কাজে লাগাচ্ছে সবাই। ফলে আশঙ্কাজনকভাবে কমছে ধবল গরুর খামার মালিকের সংখ্যা। আগে যেখানে ২০০ জনের বেশী খামারের মালিক ছিলো, এখন এসে দাঁড়িয়েছে ১০-১২তে। কোনো খামারির কাছেই ৫-৬টার বেশি গরু নেই।
ব্রিটিশ আমল থেকে মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম ছিল বিখ্যাত একটি নদীবন্দরের নাম। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে জাহাজ নোঙর করতো। তখন মিরকাদিমের এই বন্দরে লাখ লাখ মানুষের আনাগোনা ছিল, দিনরাত জাহাজের ভেঁপু বাজতো। কোলাহলমুখর থাকতো মিরকাদিম বন্দর। তৎকালীন এই বন্দরকে কেন্দ্র করে নানা রকম ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হতে থাকে বন্দরটি। তারই ধারাবাহিকতায় তেলের মিল, ধান চালের আড়তসহ শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।
ওই ধারাবাহিকতায় এখানকার ধবল গরুর চাহিদা ইতিমধ্যে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে সাদা ধবল গরু আর ভুটানের বুট্টি গরুর জন্য মিরকাদিম সারা বাংলায় বিখ্যাত। এছাড়া ভারতের উড়িষ্যা, জঙ্গলি, নেপালের নেপালি গরুও এখানে লালন পালন করা হতো। ধান-চাল আর তেলের কারখানা থাকার কারণে মিরকাদিমের ভূষি, কুড়া, খৈলসহ বিভিন্ন উন্নতমানের গরুখাদ্য খুব সহজে পাওয়া যায়। এখানকার ব্যবসায়ীরা মিরকাদিমের গরুকে মিনিকেট চালের খুদ, এক নাম্বার খৈল, ভাতের মার, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভূষি, গমের ভূষি, বুটের ভূষি খাওয়ান। এছাড়া গরু পালনে প্রশিক্ষিত লোক নিয়োগ করা হতো।
তবে দিন দিন গরুর এই ব্যবসাটিতে এখানকার ব্যবসায়ীরা উৎসাহ পাচ্ছে না। ভূষি, কুড়া আর খৈলের দাম বৃদ্ধি আর অপ্রতুল হওয়ার তারা হতাশ। তাছাড়া এর বাইরের জিনিস তারা গরুকে খাওয়ান না। এসব গরুর মাংস সুস্বাদু হওয়ার এটাই প্রধান কারণ। তাছাড়া মশারি টানিয়ে গরুকে ঘুম পাড়ানো হয়। এক কথায় গরু ব্যবসায়ীরা তাদের সন্তানের মতো করে বিভিন্ন জাতের গরু লালন পালন করেন। আর এ কারণেই মিরকাদিমের এই গরুর ব্যাপক চাহিদা দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। কোরবানির ঈদে পুরনো ঢাকাবাসীর রসনা বিলাসে আর কিছু থাকুক বা নাই থাকুক, মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমের ধবল (সাদা) গরুর মাংস থাকা চাই।
এখানকার খানদানি লোকেরা লোকজন দিয়ে কোরবানীর জন্য এসব উন্নত জাতের গরু লালন পালন করে থাকেন। তবে এসব গরুর সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ গনিমিয়ার হাটে। যুগ যুগ ধরে এই হাটে মিরকাদিমের বিখ্যাত সব গরু পাওয়া যায়। যা অনেক দামে কিনে নেয় পুরান ঢাকার খানদানি লোকেরা। এছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে খাওয়ায় সুস্বাদু এই গরু কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে রহমতগঞ্জের গনিমিয়ার হাটে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকে আবার আগেভাগে মিরকাদিমে এসে ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা দিয়ে যায়। পরে ঈদের আগে তাদের গরু বুঝে নেন। কয়েকমাস ধরে লালন পালন করে গরুর মালিককে বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়টি বহু আগে থেকেই চালু রয়েছে।
কোরবানির ঈদ উপলক্ষে সবেমাত্র এক সপ্তাহের জন্য ঢাকার রহমতগঞ্জ মাঠে (গনিমিয়ার হাট পুরনো নাম) মীরকাদিমের সাদা গরুর হাট বসে। মীরকাদিমের গরুর কদর ও দাম একটু বেশি। ৮০ হাজার থেকে ৮ লাখ টাকা গরুর মূল্য হয়ে থাকে। তবে মীরকাদিমের গরু মুন্সীগঞ্জের কোনো হাটে বিক্রি হয় না।
মিরকাদিমের ইকবাল হোসেন জানান, আগের মত ঘরে ঘরে মীরকাদিমে গরু কেউ বানায় না। রহমতগঞ্জের গনিমিয়ার হাট বলতে মীরকাদিমের গরুকে বোঝাত। এখন হাতেগোণা কয়েকজন গরু পালন করে।
গরু খামার মালিক নুর মোহাম্মদ মুন্না বলেন, ২০০ বছর ধরে আমাদের বংশ পরাম্পরায় এই গরুর ব্যবসা করে আসছি। মাঝে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আবার শুরু করেছি। এখন নেশার মতো হয়ে গেছে। তেমন লাভ না হলেও এই গরু লালন পালন না করলে অসুস্থ হয়ে পড়ি।
তিনি বলেন, মিরকাদিমের ধবল গরুর খামারিরা গরুকে যে খাবার খাওয়ায় সেটা খুবই দামী এবং ভেজালমুক্ত। খেসারীর ভুসি, বুটের ভুসি, গমের ভুসি, খৈল, মসুরী ডালের পাউডার, তিসীর খৈল, মিনিকেট চালের খুদ। একেকটা গরুর জন্য ৪০০ টাকা খরচ হয় প্রতিদিন। অপরদিকে মনোপুলি যারা করে যাচ্ছেন তারা বিষযুক্ত খাবার খাওয়াচ্ছেন। ইউরিয়া সার, খ্যার, চিকুন ভুসি, রাফ চিটা।
আনোয়ার হোসেন বলেন, এ বছর বেশী গরু তৈরী করিনি। আমার মাত্র ৪টি গরু আছে। গত বছর গরু বিক্রি করে লাভবান হতে পারিনি, কোনমতে চালান উঠে এসেছে। বিভিন্ন কারণে মীরকাদিমে গরু বানানো এখন প্রায় বন্ধ। সামনের বছর নাও পেতে পারেন। এখন আর সাদা বুট্টি গরু এখন পাওয়া যায় না, আগের বছর লোকসান খাইছি।
তিনি বলেন, মীরকাদিমের গরুর একটা ঐতিহ্য ছিল। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা পঙ্গু হইয়া যাইতাছি। ঢাকা থেকে কসম কাইটা আসি আর গরু পালুম না। দুই-তিন মাস পরে মন মানাইতে পারি না। ঢাকার হাটে এক ঘণ্টার বেচাকেনা। আমরা গরু নামাই যার ভাগ্য ভালো সে দাম ভালো পায়।
গরু খাওয়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মিনিকেট চালের খুদ, এক নাম্বার খৈল, ভাতের মার, সিদ্ধ ভাত, খেসারির ভূষি, গমের ভূষি, বুটের ভূষি গরুকে খাওয়ানো হয়।’
খামার মালিক কামাল হোসেন জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে আসা গরু কিনে এনে লালন করে থাকেন। ছোট বুট্টি গরু ১০-২০ হাজার টাকায় কিনে আনি ৪-৫ মাস লালন করে ৫০-৬০ হাজার টাকা বিক্রি হয়ে থাকে। এই গরু বেশি বড় হয় না। দেখতে গোল গাল। আর নেপালি ও ভারতের অন্য প্রজাতির বড় গরু কিনি প্রায় লাখ টাকা আর ছয় মাস লালন পালন করে বিক্রয় হয় ২ থেকে ৬ লাখ টাকা। প্রতি গরুর পিছনে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানান তিনি।
খামার শ্রমিক ইকবাল বলেন, ‘মীরকাদিমের ধবল গরু বানাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। ভারত ও ভুটানের আবাল-পশ্চিমা সাদা ষাঁড় ও সাদা গাভীর বাচ্চা কিনে আনেন মীরকাদিমের খামারিরা। নিজের বাচ্চার মতো লালন করি। নতুন গামছা দিয়ে গোসল করাই। সব সময় চোখে চোখে রাখি। প্রতিটি গরু বড় করতে ও কোরবানির হাটে বিক্রি করার জন্য উপযোগী করে তুলতে ৪-৬ মাস সময় লাগে।’
তিনি বলেন, ‘ইনজেকশন বা গরু মোটাতাজার কোনো ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। সাদা গরু এখন পাওয়া যায় না তাই বিভিন্ন রংয়ের গরু বানানো হয়। খামারের ভেতরের পরিবেশ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। বাইরের কাউকে খামারের ভেতর ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হয় না।’