৩শ’ অতিথি নিয়ে করোনা আতঙ্কের মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিলেন সিভিল সার্জন
করোনায় মৃত্যুর মিছিল চীন থেকে শুরু, কিন্তু ইরান ও ইতালিতে তার ভয়াবহতা বেশি। সেই সঙ্গে যুক্ত হলো বাংলাদেশ। এরই মধ্যে করোনায় একজনের মৃত্যু খবর পাওয়া গেছে। আক্রান্তের সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে। এ নিয়ে যখন সারা দেশে সতর্কতা জারি করে তৎপর সরকারের শীর্ষ পর্যায়। তখনই চিকিৎসক মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে জনসমাগমের আয়োজন করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো.শাহ আলম।
অথচ এই শাহ আলমের মতো অনেকেই করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কে। দিন দিন পরিবার পরিজন ছেড়ে নিরাপত্তাহীন জেনেও মানুষের সেবা করে যাচ্ছে। চিন্তা করছেন করোনা মোকাবিলায় নতুন কি পদক্ষেপ নেয়া যায়। কিন্তু, কিভাবে চিকিৎসকদের শীর্ষ কর্মকর্তা হয়েও তিনি এমন কাণ্ড করলে, সেই প্রশ্নে সচেতন মহলে সমালোচনা ঝড় উঠেছে।
শুক্রবার (২০ মার্চ) জেলা শহরের দাতিয়ারা ফারুকী পার্ক সংলগ্ন জেলার সরকারি কর্মকর্তাদের ডরমেটরিতে থাকা সরকারি বাসভবনে এই বিয়ের আয়োজন করেন সিভিল সার্জন। বিয়ের আয়োজনে শামিল হয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, জেলার বিভিন্ন এলাকার চিকিৎসক, ক্লিনিক মালিক। বিয়েতে আড়াই থেকে তিন শতাধিক অতিথিকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে বলে একটি নির্ভর যোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
করোনা ভাইরাস মধ্যে বিয়ের আয়োজন প্রসঙ্গে এই সিভিল সার্জন বলেন, এটি সাদামাটা ভাবে ঘরোয়া আয়োজন করা হয়েছে। বিয়েতে কোনো জনসমাগম হয়নি বলে দাবি করেছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বাসুদেব ইউনিয়নের চাপুইর গ্রামের বাসিন্দা মোশারফ হোসেন মোল্লার ছেলে প্রকৌশলী মইনুল হোসেনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে সিভিল সার্জনের মেয়ে দন্ত চিকিৎসক শাননিন আলম মমোর বিয়ের আয়োজন করা হয়। আয়োজনে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর শুরু হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও খাবার পর্ব। দুপুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান ডা. আবু সাঈদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ফায়েজুর রহমান, গাইনি চিকিৎসক ফৌজিয়া আক্তার, মেডিকেল অফিসার সৈয়দ আরিফুল ইসলাম, হবিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক আজহারুর রহমান ও খোকন দেবনাথ।
এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন ক্লিনিকের একাধিক দল, খ্যাতিমান ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মচারী সহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
দাওয়াত বিহীনভাবে বিয়ে বাড়ির আশপাশে সাংবাদিকদের আনগোনা দেখে বিকেল পৌনে তিনটার পর সিভিল সার্জনের সরকারি বাসভবনে প্রধান ফটকের গেইট বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু আমন্ত্রিত অতিথি ব্যতীত বিয়ে বাড়িতে অপরিচিত কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ফটকের বাইরে সিভিল সার্জন শাহ আলম নিজেই পায়চারী করছিলেন।
এ সময় সময় টিভির রিপোর্টারকে দেখে চমকে উঠেন তিনি। এসময় তিনি ওই সাংবাদিককে প্রশ্ন রেখে বলেন আমি কি মেয়ের বিয়ে দেবো না?
নাম না প্রকাশ করার শর্তে বিয়ে বাড়ীতে দাওয়াত খেয়ে আসা এক রাজনৈতিক নেতা জানান, বাহিরে বুঝার উপায় নেই ভেতরে বিশাল আয়োজন। মূল গেইটের ভেতরে ফুল দিয়ে একটি ছোট তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। আর বাড়ির ভেতরে তৈরি করা হয়েছে প্যান্ডেল। খোলা জায়গায় ৮ থেকে ১০টি বড় ডেক্সি ও চসমানে চলে রান্নার কাজ। তিনি আরো জানান, খাবারের তালিকায় বাহারি রকম ছিল, সাদা ভাত, গরুর মাংস, মুরগি, চিংড়ি, রুই মাছ, জর্দা, কোমল পানীয়, দই, পোলাও ছাড়াও খাবার শেষে ঐতিহ্যবাহী পান সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন ছিল।
এ ব্যাপারে টিআইবি সহযোগী সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সহ-সভাপতি আব্দুন নূর বলেন, করোনা ভাইরাস আতঙ্কে সারাদেশে জনজীবন যখন থমকে যাওয়ার উপক্রম। আতঙ্কে সাধারণ মানুষ। কয়েকটি স্থানে লক ডাউন করা হয়েছে। মরণঘাতী এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে গণজমায়েত সহ লোক সমাগম এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঠিক এমন সময় এই আয়োজন কোনো ভাবে কোনো যৌক্তিক কারণ হতে পারে না।
তিনি উল্লেখ করে বলেন, বিভিন্ন স্থানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বিয়ের আয়োজন বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। তিনি (সিভিল সার্জন) নিজেও সেই নির্দেশনার পক্ষে সায় দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি তার মেয়ের বিয়ের আয়োজন করে সেই গ্রহযোগ্যতা হারিয়ে দৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের কাছে করোনা আতঙ্কের মধ্যে বিয়ের আয়োজন করতে চাইলে তিনি বলেন গত, পাঁচদিন আগে থেকে শুনেছি বিয়ের আয়োজন চলছে। আজ সিভিল সার্জন তার কন্যাকে শুনেছি আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দিয়েছেন। এ ঘটনায় আমি বিব্রত। এর বেশি আর কিছু বলতে চাইনা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন শাহ আলম বলেন, এক মাস আগেই বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। আমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে দেবো না? তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বৃহস্পতিবার মেয়ের গায়ে হলুদ হয়েছে। আজ বিয়ে। আমরা দশ ভাই বোন। তাদের ছেলে মেয়ে ২৭ জন। কয়েকজন আত্মীয় স্বজন আছে। আমি বাবা হয়ে কীভাবে মেয়ের বিয়ে বন্ধ করে দেই? পরিবারের অনেক সদস্য ও বিশিষ্টজনদের দাওয়াত দিতে পারিনি।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন বলেন, আইন সবার জন্যেই সমান। তিনি এই আয়োজন করে থাকলে উনার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। করোনা ভাইরাসের জন্য জনসমাগম এড়িয়ে চলার জন্য সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। কেউই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। আমরা এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছি।