গাছে উঠে শিক্ষার্থীর অনলাইনে ক্লাস নেটওয়ার্ক ‘বিড়ম্বনা’য় ঢাবি !
মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। তাই বন্ধ রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও (ঢাবি)। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিচু বিভাগের অনরাইনের মাধ্যমে ক্লাস চলছে। এই অনলাইন ক্লাস করতে গিয়েই বিড়ম্বনায় পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়ের হোসাইন।
জোবায়েদ হোসাইন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পর থেকেই ঝিনাইদহে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছি। গত জুন মাস থেকে আমার বিভাগে অনলাইনে ক্লাস চালু হয়। এর পর থেকেই আছি মহা বিপাকে। কারণ, আমার এলাকায় ইন্টারনেটের দুর্বল নেটওয়ার্ক। এর মধ্যেও আমি কয়েকটা ক্লাস করেছি। কিন্তু নেট এতো দুর্বল যে, ঠিকমতো টিচারদের লেকচার দেখা কিংবা শোনা যায় না। একদিনতো এমনও হয়েছে যে, ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে বাফারিং শুরু হলো। নেটওয়ার্ক নেই। তখন বাকি ২৫ মিনিট আমাকে গাছে উঠে ক্লাস করতে হয়েছে।’
জোবায়েদ আরো বলেন, ‘ইন্টারনেট তূলনামূলক ভালো পাওয়ার জন্য এখন আমাকে বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে অনলাইনে ক্লাস করতে হয়।’
এখন আবার জোবায়েদ হোসাইনের ইন্টারনেটের খরচ নিয়ে আরেকটি নতুন চিন্তা বেড়েছে। সপ্তাহে যদি ২০টা ক্লাস হয়, তাহলে সে হিসেব করে দেখেছে ছয় থেকে সাতশত টাকা খরচ হবে।
ঢাবির এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘মহামারীর এই সময়ে আমার পরিবারের পক্ষ থেকে এই টাকা যোগান দেয়া সম্ভব নয়। ঢাকায় টিউশনি করে আমি আমার নিজের খরচ নিজেই চালাতাম। এখন সেটাও বন্ধ।’
গত মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ১৯ হাজার শিক্ষার্থীর উপর একটি জরিপ পরিচালনা করে। ইউজিসি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, জরিপে তারা দেখতে পেয়েছেন ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্টফোন রয়েছে।
কিন্তু যাদের স্মার্টফোন নেই কিংবা থাকলেও নেটওয়ার্কের দুর্বলতা বা ইন্টারনেটের ব্যয় বহন করার মতো অবস্থায় নেই, তারা ক্লাস করতে না পারায় পিছিয়ে পড়বে বলে অভিযোগ করছেন শিক্ষার্থীরা।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হানা সুলতানা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি এখন পর্যন্ত কোন ক্লাসেই অংশ নিতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘আমার স্মার্টফোন আছে, কিন্তু পুরো এলাকায় ভালো নেটওয়ার্ক নেই। সব সময় টুজি স্পিড। তাছাড়া আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে ইন্টারনেটের খরচ জোগানোও অসম্ভব। আমাদের ক্লাসে এরকম আরো অনেকে আছে যারা প্রত্যন্ত এলাকায় থাকে। আমরা তো ক্লাস করতে না পেরে পিছিয়ে পড়ছি।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষার্থী নাজাহ নাহিয়ান বলেন, ‘আমাদের ক্লাসে ২০০ শিক্ষার্থী আছেন। এখন ৫০ জন ক্লাস করতে পারছেন না। এটা কি তাদের শিক্ষাজীবনে ক্ষতি হচ্ছে না? এখানে তো অনলাইন ক্লাস বৈষম্য তৈরি করছে। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, আমরা যেনো অনলাইন কোর্স করছি। যাদের টাকা আছে বা সুবিধা আছে তারাই এটা নিতে পারছে।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরো আগেই অনলাইন ক্লাস চালু করলেও সেখানকার শিক্ষার্থীরাও নানা অভিযোগ করছেন। ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মুমু মমতাজ বলেন, ‘নেটওয়ার্ক সমস্যা ছাড়াও পড়া বুঝতেও সমস্যা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সরাসরি ক্লাসে যেভাবে পড়া বোঝাতেন টিচাররা, এখানে সেভাবে হচ্ছে না। তাছাড়া সিনিয়র টিচার যারা আছেন, তাদের অনেকেরই অনলাইনের প্রযুক্তিতে ঘাটতি আছে। তারাও চেষ্টা করছেন, কিন্তু সমস্যা হচ্ছেই। এছাড়া ঢাকার বাইরে আমাদের যেসব বন্ধুরা আছে, তারাও নেটওয়ার্কজনিত সমস্যায় ভুগছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী জানান, ল্যাপটপ না থাকায় তাকে হাজার দুয়েক শব্দের এস্যাইনমেন্ট মোবাইলেই লিখতে হচ্ছে। যেটা খুবই কষ্টকর।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, শিক্ষার্থীদের এসব সমস্যা তারাও অবহিত আছেন। কাউকে বেশি সুবিধা দেয়া বা কাউকে বঞ্চিত রাখা -এমন উদ্দেশ্য তাদের নেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের এতোগুলো ছেলে-মেয়ে তাদের কী কী সাপোর্ট লাগবে? কারো হয়তো স্মার্টফোন লাগবে, কোথাও হয়তো আর্থিক সাহায্য লাগবে। এগুলো লাগবে।’
‘কিন্তু তারপরেও বলছি, এগুলোর ব্যবস্থা করে তারপরে কি অনলাইনে যাবো? নাকি আগেই যাবো, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়েই আমরা শুরু করি। তাহলে কোথায় ঘাটতি আছে, কতটুকু কী লাগবে সেটি বুঝে নিরূপণ করা সহজ হবে’ বলেন তিনি।
উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান আরো জানান, ক্লাস শুরু হলেও অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে তখন পর্যাপ্ত রিভিউ ক্লাস নিয়ে ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা হবে। তবে এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আইটি অবকাঠামো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য সরকারের অর্থ সাহায্য লাগবে বলেও মত দেন তিনি।
একই মত দিয়েছেন বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম এম শহিদুল হাসান। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঋণ সাহায্য দরকার। প্রত্যেক ইউনিভার্সিটিতে একটা আইটি সেক্টর আছে। সেই আইটি সেক্টর একটা ধারণা দিতে পারবে, তাদের কী করতে হবে। এখানে কিছু প্রবলেমও আছে। যেগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের জন্য ইউজিসির মাধ্যমে সরকারের কাছে যেতে হবে। যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। এখানে ইউজিসিকে একটা কো-অর্ডিনেশনের ভূমিকা নিতে হবে।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী শহীদুল্লাহ জানিয়েছেন, কমিশনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের যে বৈঠক হয়েছে সেখানে নানারকম দাবি-দাওয়া, পরামর্শ এসেছে। শিক্ষার্থীদের সহায়তা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ঋণের ব্যবস্থা, ফ্রি ইন্টারনেট এ ধরেণর দাবিগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।