অপেক্ষার পালা শেষ হয়েও হইলো না মেহেরপুর পৌরসভা নির্বাচন !
আল-আমীন সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার Channel 4TV :
মেহেরপুর পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে জটিলতা যেন পিছু ছাড়ছে না। মামলা সংক্রান্তজটিলতা কাটিয়ে ২৫ এপ্রিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও মেয়র পদের ফলাফল পেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দুটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হওয়ায় চুড়ান্ত ফলাফল দেখতে পাননি পৌরবাসী। তাই পৌরবাসীর অপেক্ষার পালা ‘শেষ হয়েও হলো না’ এমন মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
পৌর এলাকার কয়েকজন ভোটার বলেন, বার বার মামলার বেড়াজালে নির্বাচন আটকে গিয়েছিলো। তাই এবারো ভোটারদের মাঝে এক প্রকার শংকা ছিলো। তবে মামলার বেড়াজালে আটকে না গেলেও দুটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত হওয়ায় শেষ হয়েও নির্বাচন শেষ হয়নি।
গত ২৫ এপ্রিল মেহেরপুর পৌরসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। মেয়র প্রার্থীদের একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা ছিল। সকাল ৮টা থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ১৫টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। সুষ্ট নির্বাচন করতে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও র্যাব সদস্যদের মাঠে নামানো হয়। প্রায় দুই ঘন্টা ভোট গ্রহণ করা হয়। সকাল থেকে কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের সরব উপস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছিল এই ভোট পৌর নাগরিকদের কাছে কতটা কাঙ্খিত ছিল। এরপর সকাল পৌনে দশটার দিকে আকস্মিকভাবে ৭নং ওয়ার্ডের সরকারী উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের দুটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করেন রির্টানিং অফিসার। ওই সময় ভোট কেন্দ্র দুটিতে বিপুল সংখ্যক ভোটার ভোট দেয়ার জন্য লাইনে অবস্থান করছিলেন। তাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ওদিনই কেন্দ্র দুটিতে পুনরায় ভোট গ্রহণ না হওয়ায় মেয়র ও ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীদের ফলাফল আটকে যায়।
১৩ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়। ফলাফলে নৌকা প্রতীক ১ হাজার ৩৬৮ ভোটে এগিয়ে থাকে। মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জেলা যুবলীগের আহবায়ক মাহফুজুর রহমান রিটন (নৌকা) ৯ হাজার ২০৯ ভোট পান। সব জল্পনা-কল্পনা ছাপিয়ে বর্তমান মেয়রকে পিছনে ফেলে মূল প্রতিদ্বন্দীতায় আসেন বিএনপি প্রার্থী। বিএনপি প্রার্থী পৌর বিএনপির সভাপতি জাহাঙ্গীর বিশ^াস (ধানের শীষ) পান ৭ হাজার ৮৪১ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান মেয়র মোতাচ্ছিম বিল্লাহ মতু (নারকেল গাছ) ২ হাজার ৬৩২ ভোট ও প্রার্থী নিশান সাবের (মোবাইল ফোন) ৫৭ ভোট পান।
মেহেরপুর পৌরসভা নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৩০ হাজার ৯৬৫ জন। নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যে ভোটের ব্যবধান ১ হাজার ৩৬৮। স্থগিত হওয়া কেন্দ্র দুটির ভোটার সংখ্যা ৪ হাজার ৫৬৩। সে হিসেবে মেয়র পদে বিজয়ী নির্ধারণে কেন্দ্র দুটিতে পুনরায় ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হচ্ছে। তবে প্রতিদ্বন্দীতা থেকে ছিটকে পড়েছেন মোতাচ্ছিম বিল্লাহ মতু ও নিশান সাবের। পুনরায় ভোট গ্রহণ হলে প্রতিদ্বন্দীতা হবে মূলত নৌকা ও ধানের শীষের মাঝে। যেকোন সময় নির্বাচন কমিশন কেন্দ্র দুটিতে পুনরায় ভোট গ্রহণের তারিখ ঘোষণা করবে বলে জানান জেলা নির্বাচন অফিসার। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কে হবেন পরবর্তী পৌর মেয়র তা দেখার অপেক্ষায় মেহেরপুর জেলাবাসী।
দুটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারদ্বয় সকালে রিটার্নিং অফিসারের কাছে ভোট বন্ধের জন্য লিখিত আবেদন করেন। তারা আবেদনে উল্লেখ করেন যে, ভোট গ্রহণের আগের রাতে দুর্বৃত্তরা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে তাতে সিল মেরে বাক্স বন্দি করে। তবে রাতে এ ঘটনা ঘটলে দুই ঘন্টা ভোট গ্রহণের পরে কেন ভোট গ্রহণ স্থগিত হলো সে প্রশ্নের সদুত্তোর মেলেনি সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। ফলে প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে এক প্রকার ক্ষোভ বিরাজ করছে।
ভোটাররা বলছেন, পুনরায় ভোট গ্রহণের কারণে ফলাফলে প্রভাব পড়তে পারে। ২৫ তারিখে ভোটের দিন যে ফলাফল হতো তা এখন নাও হতে পারে। অপরদিকে আর্থিক অপব্যয়ের মাঝে পড়েছেন প্রার্থীরা। নানা অজানা আশংকা বিরাজ করছেন ভোটার ও প্রার্থীদের মনে। কবে ভোট গ্রহণ হবে ? এবং কে বিজয়ী হবেন তা নিয়ে আবারো শুরু হয়েছে নানান হিসাব-নিকাশ ও চুলচেরা বিশ্লেষণ।
২০১৫ সালে বর্তমান পৌর পরিষদের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্তি হয়েছিল। ওই বছরের শেষের দিকে দেশের মেয়াদোত্তীর্ণ ২৩৪টি পৌরসভার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমদহ ইউনিয়নের সঙ্গে পৌরসভার সীমানা সংক্রান্ত জটিলতার মামলার কারণে মেহেরপুর পৌরসভার নির্বাচন হচ্ছে না বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। ওই মেয়াদে গাংনী পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনী তফশীল ঘোষণার দাবিতে রাজপথে নামেন পৌরসভার বিভিন্ন স্তুরের নাগরিকরা। জেলা যুবলীগের আহবায়ক মাহফুজুর রহমান রিটন ও যুগ্ম আহবায়ক শহিদুল ইসলাম পেরেশানের নেতৃত্বে ২০১৫ সালের ২৮ নভেম্বর মেহেরপুর শহরে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। ৩০ নভেম্বর একই দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল পৌর মেয়র মোতাচ্ছিম বিল্লাহ মতু এবং আমদহ ইউপি চেয়ারম্যান আনারুল ইসলামের কুশপুতুল দাহ করে বিক্ষোভকারীরা। আইনী জটিলতা সৃষ্টি করে নির্বাচন পিছিয়ে ক্ষমতায় থাকার অভিযোগ তোলেন আন্দোলনকারী।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে মেহেরপুর পৌরসভা ও আমদহ ইউপি নির্বাচনের তফশীল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। পৌরবাসীর মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। শহরে আনন্দ মিছিলও হয়। ৬ অক্টোবর ধুমধামে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন মেয়র ও কাউন্সিলর পদের প্রার্থীরা। নির্বাচন ঘিরে উৎসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কিন্তু পৌরবাসীর সেই সুখ স্থায়ী হয়নি। মনোনয়নপত্র দাখিলের পরে সন্ধ্যায় তফশীল স্থগিতের খবর প্রার্থী ও ভোটারদের মাথায় অনেকটা বজ্রপাতের মতই বিধে। আবারো রাস্তায় নামে জনতা। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়। ভোটের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসুচীও পালিত হয়। উচ্চাদালতের আদেশে ওই তফশীল স্থগিত করেছিল নির্বাচন কমিশন।
পৌরসভার নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্দোলনকারীদের মতই সক্রিয় ছিল জেলা নির্বাচন অফিস ও নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে মেহেরপুর পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের বিতর্কিত সেই ভোটারদের আমদহ ইউনিয়নের মধ্যে ফিরিয়ে দেয় জেলা নির্বাচন অফিস। মামলা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের পর গত ১৪ মার্চ পুনঃতফশীল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত তফশীল অনুযায়ী ২৭ মার্চ মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। যাচাই-বাছাই ২৯ মার্চ ও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ৫ এপ্রিল। ৬ এপ্রিল প্রতীক বরাদ্দ হয় এবং আগামি ২৫ এপ্রিল আসে ভোট গ্রহণের সেই মাহিন্দ্রক্ষণ।
এ নির্বাচনে মেহেরপুর পৌরসভায় প্রথমবারের মত দলীয় প্রতীক দেয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এতে জাতীয় নির্বাচনের মতই আবহ সৃষ্টি হয়। শুরু হয় ভোটের প্রচার-প্রচারণা। ভোট ঘিরে এক অন্যরকম উৎসব শুরু হয় পৌরসভা এলাকায়। দীর্ঘদিন পরে ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা ছিলেন অনেকেই। কথায় আছে ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তার’। এই কথাটি অন্তত মেহেরপুর পৌরবাসীর ক্ষেত্রে ফলেছে। এমনটি জানিয়ে দ্রততম সময়ের মধ্যে সুষ্ট পরিবেশে দুটি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন পৌরবাসী।