শাকিব খানকে নিয়ে বিতর্কের শেষ কোথায়?
পুরো চলচ্চিত্র অঙ্গন আজ একরকম অস্থিতিশীল। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ; বয়কট, পাল্টা ব্যবস্থা; নিষিদ্ধ, পদত্যাগ—এমনি নানা কিছু ঘটছে। কিন্তু এই সব কিছু কি চলচ্চিত্রের স্বার্থেই ঘটছে? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য অনেক কিছু? কেউ কি এসব গল্পের সঠিক অনুসন্ধান করেছি? গত শতকের নব্বই দশকের চিত্রনায়ক প্রয়াত সালমান শাহর নাম এখনো অনেকেরই মনে আছে। অল্প সময়েই তিনি দারুণ জনপ্রিয় হন, খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে যান। সালমান শাহ আছে, তার মানে এই ছবি ব্যবসা সফল হবে, প্রযোজকের লগ্নি করা টাকা উঠে আসবে। আর তা সালমান শাহ নিজেও বেশ জানতেন। এ কারণেই প্রযোজকদের বন্ধু না হয়ে তাদের ওপর ক্রমেই চড়াও হন। ৩–৪ লাখ টাকা পারিশ্রমিক থেকে দ্রুত ৮–১০ লাখ টাকা দাবি করেন। চলচ্চিত্রে এক সময় সালমান শাহ বন্ধুহীন হয়ে পড়েন। এ সময় সালমান শাহর পাশে এমন কিছু মানুষ জড়ো হয়, যারা তাকে নানা ব্যাপারে আপত্তিকর পরামর্শ দিয়েছে, সহযোগিতার অভিনয় করেছে, সালমান শাহর কাছ থেকে আর্থিকসহ নানা সুবিধা নিয়েছে। এই সবই এক সময় সালমান শাহর জন্য বিপদ ডেকে আনে। পরিচালক আর প্রযোজকসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা একাধিকবার বাধ্য হন সালমান শাহর বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নিতে এবং পরে তাকে চলচ্চিত্রে বয়কট করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর এক রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করেন সালমান শাহ। এখানে তিনি সবার কাছে অনুরোধ করেন, ‘চিত্রশিল্পের স্বার্থেই আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত বন্ধ করুন।’ পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই আহ্বানের কিছুদিন পর ৯ সেপ্টেম্বর রহস্যজনক মৃত্যু হয় তার। তবে ওই সময় অনেকেই বলেছেন, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট নানা ব্যাপারে হতাশা আর বিষণ্নতার কারণে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। এবার আসুন আজকের প্রেক্ষাপটে। ১৯৯৬ সালের ওই ঘটনাগুলো এফডিসিতেই ঘটেছিল। ২০১৭ সালেও প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঠিক একই স্থানে ঘটছে। এবার চিত্রনায়ক শাকিব খান। শাকিব খানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে সালমান শাহর সেই সব ঘটনার খুব বেশি পার্থক্য মনে হচ্ছে? শাকিব খান এখন বলছেন, ‘আমি ষড়যন্ত্রের শিকার।’ এখানে সালমান শাহ কিংবা শাকিব খানকেই দোষ দিলে চলবে না। তাদের আশেপাশে যারা আছেন, যারা তাদের নিয়ে সব সময় কাজ করছেন, তার ওপর নির্ভর করে যেখানে একটা পুরো চলচ্চিত্র শিল্প টিকে আছে—তারা সবাই দায়ী। আমরা তাদের তেমন কোনো শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারিনি, যে শিক্ষা তাদের বলে দেবে—ওই জায়গায় পৌঁছুলে আপনাকে কী করতে হবে? তখন কে আপনি? আপনার আচরণ কেমন হবে? কী হবে আপনার মুখের ভাষা? সাংসারিক, পারিবারিক এবং সামাজিক দিকগুলো আপনি কীভাবে সামলাবেন? এসব কিছুই তারা শেখা বা জানার সুযোগ পাননি। কেউ হয়তো বলবেন, তারাও তা চাননি। সালমান শাহ যখন মারা যান, তখন অনেকেই চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। মান্না, ওমর সানি, রিয়াজ, ফেরদৌস—আরও অনেকে। শেষ পর্যন্ত দর্শক বেছে নেয় মান্নাকে। ২০০৮ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি মান্নার মৃত্যুর পর কিন্তু অনেক নায়ক ছিলেন চলচ্চিত্রে। কিন্তু তারপরও বিশাল শূন্যতা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে দর্শক শাকিব খানকে গ্রহণ করে। আজ যখন শাকিব খানকে চলচ্চিত্রে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তখন কেউ কি ভেবেছেন, এরপর এই শিল্পের কী হবে? যারা এখন কাজ করছেন, দর্শকদের কাছে তাদের সবার কতটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। অনেক নায়কই তো এখন কাজ করছেন, কিন্তু তাদের ছবি কতটা ব্যবসা করতে পারছে? আর যে সমস্যা নিয়ে এত কিছু, সেই যৌথ প্রযোজনার ছবির ব্যাপারে শাকিবের কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয়। এখানে তিনি অভিনয় করেছেন মাত্র। এ ব্যাপারে কথা বলবেন ছবির প্রযোজক এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। শাকিব কেন বারবার এসব নিয়ে কথা বলছেন? নিজেকে বিতর্কিত করছেন? এসব ঘটনায় শাকিব খানের সামনে আসার সাথে জড়িত চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন। এখানে তিনি যেমন নিজে থেকে অনেক কিছু করেছেন, যা তার অবস্থান থেকে করার কথা নয়; আবার তার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। সেই থেকে ঘটনা, নানা দুঘর্টনার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ঘটনা এখানেই শেষ নয়, সামনে আরও অনেক কিছু ঘটবে। যৌথ প্রযোজনার ছবি চলবে নাকি চলবে না, কীভাবে চলবে—এসব সরকারের সিদ্ধান্ত। এর জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করতে হবে। এ ধরনের চলচ্চিত্রের দ্বারা রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়, এমন কোনো কাজের সাথে সরকারের কোনো মন্ত্রীর জড়িত থাকার অভিযোগ সেই সরকারের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুন্ন করবে। এখানে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে ওঠে জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শাকিব খানের আজকের এই অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন মহল। এসব মহল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কতটা ভালো চায়, সে ব্যাপারেও প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা আশা করব, চলচ্চিত্রের শিল্পী আর কলাকুশলীদের মাঝে ব্যক্তিগত রেষারেষি বন্ধ হউক। আপনাদের এই কোন্দলের সুযোগে যে কোনো অপশক্তি সহজেই আমাদের চলচ্চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।