আল্লাহর উপহার ঈদ মুমিনের জন্য
ঈদ মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় উৎসব। ঈদ আরবী শব্দ। যে দিন মানুষ আনন্দ উদযাপনের জন্য একত্রিত হয় এবং যে দিনটি বার বার ফিরে আসে এমন দিনকে ঈদ বলা হয়। আল্লামা মুল্লা আলী কারী (র.) বলেন, ‘আনন্দ উদযাপনের জন্য একত্রিত হওয়াকে ঈদ বলে।’ (মিরকাত) আল্লাহ পাক মুসলিম উম্মাহর প্রতি রহমত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। হাদীসে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনাতে আগমন করলেন, তখন মদীনাবাসীদের দুটো দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এ দু দিনের কী তাৎপর্য আছে? মদীনাবাসীগণ উত্তর দিলেন, আমরা মূর্খতার যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ (আবূ দাউদ: ১১৩৬) বর্ণিত হাদীস থেকে ঈদের তাৎপর্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে যে, আল্লাহ পাক উম্মতে মোহাম্মদীকে সম্মানিত করে এ দু‘টি ঈদ দান করেছেন। আর এ দু’টি দিন বিশ্বে যত উৎসবের ও শ্রেষ্ঠ দিন রয়েছে তার সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সেরা দিন ঈদ।
ইসলামের এ দু উৎসবের দিন শুধু আনন্দ-ফুর্তির দিন নয়; বরং এ দু’টি দিনকে আনন্দ-উৎসবের সাথে সাথে মহান প্রতিপালকের ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা সুসজ্জিত করা হবে। যিনি জীবন দান করেছেন, দান করেছেন সুন্দর আকৃতি, সুস্থ শরীর, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তানাদি, পরিবার-পরিজন, যার জন্য জীবন ও মরণ তাকে এ আনন্দের দিনে ভুলে থাকা হবে আর সব কিছু ঠিকঠাক মত চলবে এটা কীভাবে মেনে নেয়া যায়? তাই ইসলাম আনন্দ-উৎসবের এ দিনটাকে রাব্বুল আলামীনের ইবাদত-বন্দেগী, তাঁর প্রতি শুকরিয়া-কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দ্বারা সু-সজ্জিত করেছে। তাই কেবল আনন্দ উৎফুল্লতাই ঈদ নয়; বরং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে মহা মুক্তি লাভ করা এবং আখেরাতের অশেষ জিন্দেগী যেন সুখকর হয়, কল্যাণকর হয় এটাই ঈদের সত্যিকার সাফল্য। মুল্লা আলী কারী (র.) এ প্রসঙ্গে বলেন,
‘দামী পোষাক গায়ে দিলে আর ভালো খাবার খেলেই হয় নাকো ঈদ, পরকালে ভীত হয়ে অনুগত বেশি হলে তবে তার নামই ঈদ।’ (মিরকাত, কিতাবুল ঈদাইন)
ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা মুস্তাহাব। কেননা এ দিনে সকল মানুষ ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য সম্মিলিত হয়। যে কারণে জুমআর দিন গোসল করা মুস্তাহাব, সে কারণেই ঈদের দিন ঈদের নামাযের পূর্বে গোসল করা মুস্তাহাব। ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত রয়েছে, তিনি ঈদুল-ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।
সাইদ ইবনে মুসাইয়াব র. বলেন, ‘ঈদুল ফিতরের সুন্নাত তিনটি— ১. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, ২. ঈদগাহের দিকে রওয়ানার পূর্বে কিছু খাওয়া ও ৩. গোসল করা। এমনি ভাবে সুগন্ধি ব্যবহার ও উত্তম পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব।
সুন্নাত হল ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের নামাজ আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা আর ঈদুল আজহার দিন ঈদের পূর্বে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায়ের পর কুরবানির গোশত খাওয়া। হাদীসে এসেছে, বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের নামাযের পূর্বে খেতেন না। ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে কুরবানির গোশত খেতেন। হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। ঈদের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। যখন নামায শেষ হয়ে যেত, তখন আর তাকবীর পাঠ করতেন না।
ঈদের নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এটা মুসলমান জাতির অন্যতম একটি শিয়ার বা নিদর্শন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও কুরবানি কর।’ (সূরা কাউসার: ২) অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে এ আয়াতে সালাত বলতে ঈদের নামাজকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা এ নামাজ আদায় করেছেন। কখনোই ঈদের নামাজ পরিত্যাগ করেননি। ইমাম আবূ হানীফা র. বলেছেন, ঈদের নামাজ প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ওয়াজিব।
ঈদের দিন ফজরের নামাজের পর ঈদের নামাজের পূর্বে কোনো নফল নামাজ পড়া যাবে না। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত যে ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম ঈদুল-ফিতরের দিনে বের হয়ে দু রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করেছেন, এর পূর্বে ও পরে অন্য কোন নামাজ পড়েননি।’ (বুখারী) তাছাড়া ঈদের নামাজে কোনো আজান বা ইকামত হবে না। জাবের ইবনে সামুরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বহুবার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দু ঈদের নামাজ পড়েছি কোন আজান ও ইকামাত ব্যতীত। (মুসলিম)
একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানো, অভিবাদন করা মানুষের সুন্দর চরিত্রের একটি দিক। এতে খারাপ কিছু নেই; বরং এর মাধ্যমে অপরের জন্য কল্যাণ কামনা ও দুআ করা যায়। পরস্পরের মাঝে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। ঈদ উপলক্ষ্যে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরীয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী র. বলেন, ‘যুবায়ের ইবনে নফীর থেকে সঠিক সূত্রে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, আল্লাহ তাআলা আমাদের ও আপনার ভাল কাজগুলো কবুল করুন।’ (ফতহুল বারী) তাছাড় ‘ঈদ মুবারক’ বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। ‘প্রতি বছরই আপনারা ভাল থাকুন’ বলা যায়। এ ধরনের সকল মার্জিত বাক্যের দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
অপরের প্রতি সদারচণ করা ঈদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। সদাচরণ পাওয়ার দিক দিয়ে আত্মীয়-স্বজনের মাঝে সবচেয়ে বেশি হকদার হলেন মা-বাবা। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সকল প্রকার মনোমালিন্য দূর করার জন্য ঈদ হল একটা বিরাট সুযোগ। কেননা হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে খারাপ সম্পর্ক এমন একটা বিষয় যা আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। যে আল্লাহর সাথে শিরক করে তাকে ব্যতীত সে দিন সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। কিন্তু ঐ দু ভাইকে ক্ষমা করা হয় না, যাদের মাঝে হিংসা ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তখন (ফেরেশতাদেরকে) বলা হয় এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়! এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়!! এ দুজনকে অবকাশ দাও যেন তারা নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে মিলে মিশে যায়!!! (তাহলে তাদেরও যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়) (মুসলিম) এ হাদীস দ্বারা একটু অনুধাবন করা যায় যে নিজেদের মাঝে হিংসা, বিবাদ, দ্বন্দ্ব রাখা এত বড় অপরাধ যার কারণে আল্লাহর সাধারণ রহমত তো বটেই বিশেষ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হতে হয়।