সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একমাত্র নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
‘আমার কষ্ট হচ্ছে আপনাদের ছেড়ে যেতে। তবু ভালো লাগছে যে আত্মতৃপ্তি নিয়ে আজ বিদায় নিচ্ছি। ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি না,’ দৃপ্ত কণ্ঠে আদালত কক্ষে উপস্থিত বিচারপতি ও আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একমাত্র নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
কর্মজীবনের শেষে দিনে বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টা ৩৩ মিনিটে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে বিচারকাজ শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানানোর সময় তিনি এ কথা বলেন।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা আরও বলেন, ‘ন্যায়নীতি মেনেই দীর্ঘ ১৭ বছর দেশের উচ্চ আদালতে বিচারের কাজ করেছি। তারপরেও মনের অজান্তে কোনো ভুল হয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।’
বিদায় নেয়ার আগে আজ সকালেও বিচারিক কাজে দেখা গেছে আপিল বিভাগের এই বিচারপতিকে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টা ১০ মিনিটে আপিল বিভাগের ২ নং কোর্টে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিয়ার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে বিচারকাজে বসেন তিনি।এরপর বেলা ১১ টা ৩৩ মিনিটে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে বিচারকাজে বসেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা শুধু উচ্চ আদালতেরই প্রথম নারী বিচারপতি ছিলেন না। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রথম নারী বিচারক।
নাজমুন আরা সুলতানা ফতোয়া বিষয়ক মামলা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ির মামলা, চারদলীয় জোট সরকার আমলে বাদপড়া ১০ বিচারপতির মামলা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ বিষয়ক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বিচারক ছিলেন।
১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা চৌধুরী আবুল কাশেম মইনুদ্দিন ও মা বেগম রাশিদা সুলতানা দ্বীন দু’জনই প্রয়াত।
মা ময়মনসিংহ রাঁধাসুন্দরী গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকায় নাজমুন আরা সুলতানার শৈশব কেটেছে ময়মনসিংহে। শিক্ষাজীবনও কেটেছে সেখানে।
ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন নাজমুন আরা সুলতানা।
১৯৬৯ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করার পর ময়মনসিংহ ল’ কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
ময়মনসিংহ জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে আইন পেশায় শুরু করেন ১৯৭২ সালে। এরপর ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ হিসেবে (সহকারি জজ) নিয়োগ পান। এবং ১৯৯০ সালে জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। তিনিই দেশের প্রথম নারী জেলা জজ।
২০০০ সালের ২৮ মে নাজমুন আরা সুলতানা হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ২০০২ সালের ২৮ মে হাইকোর্টে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
নারী বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডব্লিউজেএ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন নাজমুন আরা সুলতানা। এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক নারী আইনজীবী সংস্থায় দু’বার সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা সুদীর্ঘ কর্মজীবনে ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইটালি, জাপান, আমেরিকা, চীন, ইরান, ইরাক, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, পানামা ও হংকং সফর করেন।
নাজমুন আরা সুলতানা দুই ছেলে সন্তানের মা। তার বড়ছেলে কাজী সানাউল হক উপল আর ছোট ছেলে এহসানুল হক সূর্য। তার স্বামী কাজী নুরুল হক।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের পক্ষ থেকে জাজেস লাউঞ্জে বৃহস্পতিবার বিকেলে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে সংবর্ধনা জানানো হবে বলে জানা গেছে।