বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন
তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। রাজনীতির আঙিনায় সবে পা রেখেছেন। কিন্তু রাজনীতি করতে গেলে যে নীতি, আদর্শ ও আত্মবিশ্বাস থাকা দরকার তার পুরোটাই ছিল তাঁর বুকের ভেতর। একেবারে বাংলার ধুলামাটি থেকে উঠে আসা এই মানুষ নিজেকে দিয়ে বিশ্বে এই সত্য নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে বুকের ভেতর উদগ্র দেশপ্রেম আর মানুষের প্রতি নিঃসীম ভালোবাসা থাকলে সবকিছুই করা সম্ভব। তিনি সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বে তিনি এখন স্বাধীনতার প্রতীক। শোষিতের প্রতীক। স্বপ্নদ্রষ্টার প্রতীক।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহ ও সান্নিধ্য তাঁকে রাজনীতিতে একটা পথ করে দিয়েছিল একথা তিনি অকপটে শুধু স্বীকারই করেননি তিনি তাঁর কথায়, বক্তব্যে আর লেখায় তা তুলেও ধরেছেন সব সময়। বলা চলে সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরেই রাজনীতির কঠিন পথে বঙ্গবন্ধুর যাত্রা শুরু হয়। তাঁর নেতৃত্বের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল গভীর শ্রদ্বা। কিন্তু তাই বলে দলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অন্যায্য কথা আর দাবীকে মেনে নিতে হবে, এ কেমন কথা?
এতে বঙ্গবন্ধুর তীব্র আপত্তি ছিল। রাজনীতির শুরুর দিন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তাঁর এই বিশ্বাসে,সততায় আর নীতিতে ছিলেন অটল।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আমরা বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে দেখি। বিশেষ করে রাজনীতিতে তাঁর দূরদর্শিতা। আজকের দিনের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও যে তা কতো অপরিহার্য তা ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না, কেবলই বিস্ময় জাগে। আজকের দিনে রাজনীতিতে অযোগ্যদের পদ ধরে রেখে যোগ্যদের জায়গা না দেয়া কিংবা কোণঠাসা করে রাখা এবং এদের বাড়বাড়ন্ত উত্থান আর আধিপত্য দেখলে বঙ্গবন্ধুর সেই কথার উল্লেখ জরুরী হয়ে পরে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি সভার ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখছেন, “তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটা পদ দিতে বললেন। আমি বললাম কখনোই হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভালো কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব নিকাশ কোনোদিনও দাখিল করে না। শহীদ সাহেব আমাকে বললেন, who are you? you are nobody. আমি বললাম, if i am nobody, then why you have invited me? you have no right to insult me. i will prove that, i am somebody. thank you sir. i will never come to you again.
এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার যে সময়ে বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দীকে একথা বলছেন তখন তিনি মানে আওয়ামী লীগ। সোহরাওয়ার্দীর মুখের ওপর কেউ এভাবে কথা বলতে পারে এটা ভাবা সেসময়ের জন্য দুঃস্বপ্নই বটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বুকের গভীরে সাহস ছিল, অন্যায়ের বিরুদ্বে কথা বলার আত্মবিশ্বাস ছিল। আওয়ামী লীগের প্রতি ছিল গভীর আনুগত্য, গণমানুষের ভাষা বুঝতে পারার ক্ষমতা আর দেশপ্রেম। এইসব কিছু বঙ্গবন্ধুকে যুগিয়েছিল স্বপ্ন দেখার প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর সহায়-সম্বল আর শক্তি সাহস বলতে ছিল এই দেশের মানুষ, এই দেশের আকাশ, এই দেশের প্রকৃতি।
দুই.
কি এমন ক্ষতি হতো বঙ্গবন্ধু যদি সেসময় দলের শীর্ষ নেতা সোহরাওয়ার্দীর কথামতো আওয়ামী লীগে একজন আনোয়ারকে একটি পদে রেখে দিতেন? এমন কি কোনো ক্ষতি হতো? সোহরাওয়ার্দীর মতো বিশাল নেতা সেদিন বুঝতে না পারলেও বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন এইসব আনোয়ারদের দলের পদে রেখে দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে বেশি দূর এগিয়ে নেয়া কোনোদিনই সম্ভব না। রাজনীতিতে এ জাতীয় আনোয়াররা কোনো উপকারে আসবে না বরং এরা রাজনীতির আগাছা হিসেবে টিকে থেকে দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
বঙ্গবন্ধু সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ্যদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদেরকে পদে রেখে দলের কাজকে এগিয়ে নিতে হবে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। আর এখন? আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার সামনে এভাবে কথা বলার সাহস এখন ক’জন রাখেন? এখন হাইব্রিড আওয়ামী লীগার, অনুপ্রবেশকারী আওয়ামী লীগার আর অতি আওয়ামী লীগারদের চোট-পাট এতো বেশি পরিমাণে বেড়ে গেছে যে তা দেখে বঙ্গবন্ধুর সেই দিনের কথা বার বার মনে পড়ে যায়।