ভারতে গ্রেফতার হওয়া কে সেই জঙ্গি সামিউন রহমান (বেড়ে উঠার ভয়ানক গল্প)
ছনি চৌধুরী,হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : আল কায়েদার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভত বৃটিশ নাগরিক সামিউন রহমান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়ে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এনআইএ) কাছে লিখিত আবেদন করেছে বাংলাদেশ। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া ব্রিটিশ জঙ্গি নেতা কে সেই সামিউন রহমান । বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ২৭বছর বয়সী জঙ্গি সামিউন সিলেট বিভাগ হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের ফুটারচর গ্রামের মৃত হামদু মিয়ার ২য় ছেলে । ’দুই’ ভাই ’চার’ বোনের মধ্যে সামিউন রহমান ৪র্থ । সামিউনের বড় ভাই সেলিম আহমেদসহ ৪ বোন ও মা লন্ডনে বসবাস করছেন । জঙ্গি সামিউন রহমান বাংলাদেশে ৪ বার এসেছেন । ১৯৯৫ সালের দিকে প্রথমবারের মতো তার পরিবারের সাথে বাংলাদেশে আসে সামিউন । পরবর্তীতে লন্ডনে মদ,গাজা,হেরোইন সেবন করার কারণে তাকে ভালো করার জন্য সামিউনের মা ২০০৭ সালে ২য় বারের মতো বাংলাদেশে নিয়ে আসেন । দেশে আসার পর সে নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের গোপলার বাজারে জনতা ব্যাংকের নিকটস্থ তার চাচা লন্ডন প্রবাসী হাজী আব্দুল মন্নানের বাসায় উঠে । দেশে তার চলাফেরা ছিল মারাত্মক খারাপ প্রকাশ্যে মদ,গাজা,হেরোইন সেবনসহ সামিউনের আচার আচরণ ছিল খুব খারাপ । দেশে প্রায় ১বছর থাকার পর সামিউন লন্ডন চলে যায়। পরে সেখানে সামিউন রহমান ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের পুলিশ তাকে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোর অপরাধে ১ম বারের মতো গ্রেফতার করে । পরে সে অপরাধে ইংল্যান্ড আদালত তাকে দেড় বছরের সাজা প্রদান করে । লন্ডন জেল হাজতে ৬মাস কারাবাস করার পর সামিউন জামিনে বের হয়ে আসে। পরবর্তীতে ৩য় দফায় ২০১২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে আসে সামিউন । দেশে পূর্বে থাকা কালিন তার চাচা লন্ডন প্রবাসী হাজী আব্দুল মন্নানের বাসায় উঠে । এসময় অন্যরুপের সামিউনকে দেখে স্থানীয় লোকজন । মদ, গাজা, হিরোইন সেবনকারী সামিউনকে ইসলাম প্রচার সব সময় পড়নে পাঞ্জাবি মাথায় টুপি পড়িদান ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় দেখে স্থাণীয় লোকজন হতবাক হয়ে যান মনে মনে অনেক মানুষ খুশি হয় বলে জানায় একটি সূত্রটি । দেশে অবস্থান করা কালিন তার বড় ভাই সেলিম মিয়ার বিয়ে অনুষ্ঠান এ অংশগ্রহণ করে সামিউন। প্রায় ১ মাস বাংলাদেশে থাকার পর আবার ও সে লন্ডন চলে যায় । সর্বশেষ ২০১৪ সালে বাংলাদেশে আসে সামিউন এসময় সে তার চাচা আব্দুর মান্নারে পূর্বে থাকা কালিন বাসায় না উঠলে ও আব্দুল মন্নানের স্ত্রী‘র অনুরুধে আব্দুল মন্নানের অন্য একটি বিল্ডিং এ এস এন ডেফ মিনি স্টোর নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ফিছনে থাকতে দেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ফয়জুর রহমান । এসময় সে দেশে ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামাত এর সহিত আদায় করতো । বাড়ির নিকটে মসজিত থাকা সত্ত্বেও তার বাসস্থান থেকে ২কিলোমিটার দুরত্বের দেবপাড়া ইউনিয়নের বৈঠাখাল কওমী পন্থী মসজিদে নামাজ আদায় করতো সামিউন । এসময় সে তবলীগ জমায়েতে ও অংশগ্রহণ করতো । সব সময় স্থানীয় লোকজনদের ইসলামের দাওয়াত নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত করার জন্য দিক নির্দেশনা দিতেন এমনকি সব সময় মিনি কোরআন শরিফ সঙ্গে রাখতেন এবং সুযোগ পেলেই পড়তে শুরু করতেন সামিউন । ওই বছরের রমজান মাসে হযরত শাহ জালাল (র.) মাজার নিকটস্থ মসজিদে ১মাস এতেকাফ পালন করে । সব সময় একা, নিরিবিলি চলাফেরা করতো ব্রিটিশ জঙ্গি সামিউন রহমান । নিজেদের জায়গার উপর একটি মসজিদ, একটি এতিমখানা, ও একটি মাদ্রাসা স্থাপনার জন্য টাকা জমাচ্ছেন বলে তার নিকটতম এক আত্মীয়কে জানান সামিউন । এমন কী মসজিদ তৈরী করার জন্য ৫শতক জায়গা ও ক্রয় করেন তিনি । ২০১৪ সালে (১৭ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের গোপলার বাজার সামিউনের চাচা লন্ডন হাজী আব্দুল মন্নান এর বিল্ডিং এ এস.এন.ডেফ.মিনি স্টোর নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পেছনের রুম থেকে সাদা পোশাকদারী একদল পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায় । এসময় শয়ন কক্ষ থেকে বিভিন্ন ইসলামীক জিহাদী বই, বিভিন্ন দেশের সিম কার্ড, কয়েকটি মোবাইল উদ্ধার করে । পরে (২৪সেপ্টেম্বর ) জঙ্গি আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যে মামলা (নং ৫২, তারিখ ২৪/০৯/২০১৪) দায়ের করা হয়, ওই মামলাতেই গ্রেফতার দেখানো হয় সামিউনকে। মাস কয়েক আগে ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসলাম আলী শেখ তিন জনকেই অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট প্রদান করেন। সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান সিরিয়া ফ্রন্টে সশস্ত্র জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে আইএস ও নুসরা ব্রিগেডের জন্য মুজাহিদ সংগ্রহ করতে বাংলাদেশে এসেছিল। আল-কায়েদা নেতা আইমান আল জাওয়াহারী ঘোষিত একিউআইএস বা আল-কায়েদা অব ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট -এর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে জঙ্গি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যও ছিল তার। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন বলছে,দেশে কোন আইএস জঙ্গি বা তাদের কোন নেটওয়ার্ক নেই। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সামিউন পুলিশকে জানিয়েছিল, সে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিরিয়ায় গিয়ে নুসরা ফ্রন্টের হয়ে জিহাদে অংশ নিয়েছিল। জিহাদে অংশ নিতে এক ব্রিটিশ বন্ধুসহ সেসময় তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যায় সামিউন। পরবর্তীতে পিস টিভির উপস্থাপক অ্যানথনির ফেসবুক ফ্যান পেইজের সূত্র ধরে বাংলাদেশ থেকে জিহাদে অংশ নিতে ইচ্ছুক তরুণদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় বলে তৎকালিন সময় জানায় পুলিশ । জানা যায় গ্রেফতার হওয়ার কিছুদিন পর উচ্চ আদালত থেকে একে একে জামিনে ছাড়া পায় আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহী। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল মাসে উচ্চ আদালত থেকেই জামিনে ছাড়া পায় সামিউন রহমান। । স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে জামিনে বের হয়ে সে নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউয়িনের মিঠাপুর গ্রামের সামিউনের মামা কুরশ মিয়ার বাড়িতে উঠে । । এবছরের রমজান মাসে পুরো ১মাস মিঠাপুর জামে মসজিদের কোণায় একটু জায়গার মধ্যে সে একা এতেকাফ পালন করে । ভারত পুলিশের সূত্র জানায়, এবছরের জুলাই মাসে সিলেটের সীমান্ত পথে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে সামিউন। এরপর ভারতের মনিপুরে চলে যায়। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর বিহারের কিশানগঞ্জে গিয়ে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সামিউন রহমান। দেশে সামিউনের গ্রামের বাড়ি ফুটারচর গ্রামে তাদের পরিত্যাক্ত বাড়ির কেয়ারটেকার মহিলা বিদ্যা বেগম জানান,আমি বিগত ১৫বছর যাবত আমার সন্তানদের নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস করে আসছি। ২০১৪ সালে একদিন সামিউন এবাড়িতে আসে এবং বাড়ির ভেতরের গাছপালা বিক্রি করা নিয়ে তার চাচাতো ভাইদের সাথে বাকবিতন্ডা হয় । এবং ওই সময়ই সামিউন চলে যায় । আর কখনো এ বাড়িতে সে আসেনি । পরে লোকজনের মুখে শুনেছি তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে । সামিউনের চাচাতো ভাই কালিস মিয়া জানান, সামিউনের সাথে আমার দুই‘দিন দেখা এবং স্বল্প কথাবার্তা হয়েছে । শুনেছি সে নামাজ রোজা সঠিকভাবে পালন করার জন্য স্থানীয় মানুষদের উপদেশ দিত এবং সবসময় একা একাই চলাফেরা করতো । কারোর সাথে তেমন বেশি মিশতো না । পরে শুনি জঙ্গি না কী যেন এক কারণে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে । এরপর থেকে তার খোঁজখবর এখন পর্যন্ত আর পাইনি । সে যদি প্রকৃত অপরাধী হয়ে তাকে তা হলে তার উপযুক্ত বিচার চাই । সামিউনের আরেক চাচাতো ভাই মোস্তফা মিয়া জানান, সামিউনের চলাফেরা ছিল খুব ভালো সবসময় নামাজ পড়তো । তবে সে গোপলার বাজারে বাসায় থাকলেও আশেপাশে ৩-৪টা মসজিদ থাকলেও সে ২কিলোমিটার দূরে বৈঠাখাল গ্রামের কওমী মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তো । প্রায় সময় সে মোটর সাইকেল দিয়ে একাএকাই চলাফেরা করতো কারো সাথে মিশতো না । এব্যাপারে এস.এন.ডেফ.মিনি স্টোর নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সামিউনের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে ফয়জুর রহমান বলেন,সামিউন প্রথমত ছোটবেলায় তার পরিবারের সাথে দেশে আসে । পরবর্তীতে ২য় বার আসে এসময় তার চলাফেরা ছিল খুব খারাপ ,মদ গাজা সেবন করতো । তার পরিবার তাকে ভালো করার উদ্দেশ্যে প্রায় এক বছর দেশে রাখেন । কিন্তু সে নেশার জগত ছাড়তে পারেনি । পরবর্তীতে সে ২০১২ সালের শেষ দিকে আবার বাংলাদেশে আসে সামিউন । সেসময় তার চলাফেরায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন আসে । তখন সে মদ, গাজা, ছেড়ে নামাজ রোজা,কোরআন তিলাওয়াত পড়ে সময় কাটায় । তখনকার চলাফেরায় আমরা সবাই খুশি হই । মাসখানেক দেশে থেকে সে লন্ডন চলে যায় । সর্বশেষ ২০১৪ সালে সে পুনরায় দেশে আসে এবং আমার দোকানের পিছনের রুমেই উঠে । তখন দেখা যায় সবসময় তার পকেটে একটি ছোট মিনি কোরআন শরিফ রাখতো এবং কোথাও বসলে বা চলাফেরার সময়ও কোরআন তিলাওয়াত করতো এবং ফাঁকে ফাঁকে তাছবিহ ও পড়তো । আমাকে সহ যাকেই পেত তাকেই নামাজ রোজার দাওয়াত দিত । মোবাইলে বিভিন্ন ভাষার তিলাওয়াত শুনত্ ো। রাতের বেলায় সারারাত জেগে তিলাওয়াত ও শুনার ফলে আমার দোকানের কর্মচারী তার রুমে ঘুমাতে সমস্যা হত । এরপর থেকে সে অন্য রুমে ঘুমাতো আমার দোকান থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে তার সাথে আমার যোগাযোগ নেই। আমার ধারণা লন্ডন যখন সে জেলে ছিল তখন হয়তো কোনো জঙ্গি জেলের মধ্যে তাকে ব্রেইন ওয়াস করে এই ভুল পথের শিক্ষা দিয়েছে । এব্যাপারে দেবপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের স্থানীয় মেম্বার আব্দুল আজিজ বলেন, সামিউনের চলাফেরা ছিল খুব নিরিবিলি ,কারো সাথে মিশতো না,স্থানীয় আলেম উলামাদের সাথে মাঝে মধ্যে দেখা যেত । হঠাৎ একদিন রাত্রে ডিবি পুলিশের লোকেরা আমাকে নিয়ে তার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তখন জানতে পারি সে জঙ্গি । সে প্রকৃত অপরাধী হলে আমি তার কঠোর বিচারের দাবী জানাই ।