আশুলিয়ায় টাকার জন্য বর্বর নির্যাতন; মায়ের মৃত্যুতে মেয়ে আধা মরা
নিজস্ব প্রতিনিধি,সাভার: রংপুর থেকে অভারের তাড়ানায় আশুলিয়ার ঘোষবাগ এলাকায় মেয়েকে নিয়ে পাড়ি জমায় মর্জিনা। কিন্তু সেই অভাব তাড়ানা মৃত্যু দিয়ে পিছু ছাড়াতে হলো মর্জিনাকে। এখানে এসে কাজ নেয় একটি পোশাক কারখানায়। কিন্তু বাড়িতে অসুস্থ স্বামীর ওষুধের খরচ। আবার মেয়েসহ নিজের খরচ বহন করতে গিয়ে প্রতি মাসেই কিছু কিছু ঘাটতিতে পড়তে হয়েছে তাকে। ফলে বাসার পাশের মুদি দোকানি, প্রতিবেশী কাছের দেনা পড়ে যায়। সব মিলিয়ে হাজার ৩০ হাজার টাকা বেশি নয়। তবে এর খেশারত দিতে হয়েছে চরমভাবে। দোকানে বেঁধে মারধর করে মা মেয়েকে। এখানেই শেষ নয়, পাওনাদাররা মর্জিনা ও তার মেয়েকে পাশের বাড়ির অপর একটি কক্ষে গত তিন দিন ধরে আবরুদ্ধ করে রাখে। প্রতিনিয়ত গালাগালি ও অপমান অপদস্থ করতে থাকে তাদের। এমনকি মৃত্যুর আগের রাতে খেতে পর্যন্ত দেয়া হয়নি। পাওনাদার মর্জিনাকে ডেকে নিয়ে আবারও চাপ দেয় জানিয়ে দেয় টাকা না পাওয়া পর্যন্ত অবরুদ্ধ রাখবে তাদের। এদিকে ক্ষুদার্থ ও ক্লান্ত কিশোরী মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে দেখে পাশেই ঝুলে আছে মায়ের নিথর দেহ। চিৎকারের আশে পাশের লোক জড়ো হয়। খবর পেয়ে পুলিশ তালা ভেঙ্গে মায়ের মৃতদেহ উদ্ধার করে। ততক্ষণে দোকানিসহ আশেপাশের পাওনাদার সব পালতাক।
মর্জিনা বেগম রংপুর জেলার কোতয়ালী থানার শাহাজাদপুর গ্রামের শাহিন মোল্লার মেয়ে। সে আশুলিয়ার মধ্য ঘোষবাগ এলাকায় থেকে স্থানীয় নাসা গামের্ন্টেসে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।
মর্জিনার পারিবারিক সুত্র জানায়, অভাবের তাড়নায় আশুলিয়ার ঘোষবাগ এলাকায় এসে স্থানীয় পোশাক কারখানায় চাকুরী নেয় মর্জিনা। একদিকে নিজের সংসার ও অন্যদিকে স্বামীর চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতিমাসে হিমশীম খেতে হয় তাদের। ফলে আশপাশের বিভিন্ন দোকানে দেনা পড়তে শুরু করে। গত কয়েকমাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা দেনা হয়ে পড়েন তারা। পাওনাদাররাও প্রায়ই দেনার টাকার জন্য মর্জিনাকে গালমন্দ করতেন। পরে গত বুধবার বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ করেই পাশের মাছ ব্যবসায়ী বাতেন নামের এক পাওনাদার মর্জিনাকে তাদের ভাড়া বাড়ির একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখে। এর পর থেকেই সেখানে পাশের মুদি দোকানী রফিক, জসিমসহ আরো কয়েকজন পাওনাদার এসে জড়ো হয়। বিভিন্ন ভাবে তাকে অপমান ও অপদস্ত করতে শুরু করে। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত অপমান অপদস্ত করার পর গ্রাম থেকে টাকা নিয়ে আসার জন্যও চাপ দিতে শুরু করে লোকজন। সারাদিন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করার পর রাতে বাহির থেকে মর্জিনা ও তার কিশোরী কন্যাকে শারমিনকে তালা মেরে রাখা হতো। ঠিকমতো খাবারও দেয়া হতো না তাদের। অবশেষে বৃহস্পতিবার রাতে ক্ষুদার্ত কিশোরী ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের ঝুলন্ত মর দেহ দেখতে পেয়ে চিৎকার শুরু করে দেয়। পরে বিষয়টি স্থানীয়রা আশুলিয়া থানায় অবহিত করলে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে নিহতের মরদেহটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
নিহত মর্জিনার মেয়ে শারমিন বলেন, স্থানীয় দোকানীসহ আশপাশের বিভিন্ন লোকজন তাদেরকে তিনদিন বাতেনের কক্ষে আটকে রাখে। ঠিকমতো খাবারও দিতো না তাদের। আর প্রতিদিন রাত ১০টার পর লোকজন তার মাকে ওই কক্ষ থেকে বের করে বাহিরে নিয়ে গিয়ে যেত। পরে রাত ১২ টার দিকে আবার কক্ষের ভেতরে দিয়ে বাহির থেকে কক্ষ তালা দিয়ে রাখতো। প্রতিদিন তার মা কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করার পর তারা ভেতর থেকে দরজা আটকিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। তবে বৃহস্পতিবার রাতে ভেতর থেকে কক্ষ না আটকিয়ে কিশোরী তার মায়ের সাথে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের ঝুলন্ত লাশ দেখে চিৎকার-আত্ননাত শুরু করে দেয় তারা। পরে দুপুরের দিকে পুলিশ তালা ভেঙ্গে নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। তৎক্ষনে পাওনাদাররা এলাকা থেকে সটকে পড়েন।
শুক্রবার সরেজমিনে ঘোষবাগ এলাকার রফিকের ভাড়াটিয়া বাতেনের বাড়ির ওই কক্ষে গিয়ে দেখা যায়। মেঝেতে মর্জিনার মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। পাশেই তার কিশোরীর আর্তনাত করে কাদছে। তবে কক্ষের সিলিং থেকে মেঝের দুরত্ব কম হওয়া এটি হত্যা না আত্নহত্যা সে বিষয়ে স্পষ্ট হতে পারেনি পুলিশ।
এব্যাপারে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আওয়াল বলেন, বিষয়টি হত্যা না আত্নহত্যা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে এটি আত্নহত্যার ঘটনা। নিহতের লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি চলছে বলেও তিনি জানান। এছাড়াও পলাতক ব্যক্তিদের আটকের জন্য অভিযান রয়েছে বলেও তিনি জানান।