মামলার জট কমাতে যাত্রা শুরু করেছে জাতীয় আইন ও বিচার সমন্বয় কমিটি।
দেশের আদালতগুলোতে বছরের পর বছর ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা ৩৩ লাখের বেশি মামলার জট কমাতে যাত্রা শুরু করেছে জাতীয় আইন ও বিচার সমন্বয় কমিটি।
আইন ও বিচার বিভাগ এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) যৌথ উদ্যোগে গঠিত এ কমিটিতে সভাপতিত্ব করবেন আইনমন্ত্রী। সমাজকল্যাণ, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছাড়াও কমিটিতে থাকবেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
আর দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে কমিটিতে থাকবেন আইন সচিব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, আইন কমিশনের প্রতিনিধি, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের প্রতিনিধি, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব, স্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, কারা মহাপরিদর্শকসহ আইন ও বিচার প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্টরা।
মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ন্যাশনাল জাস্টিস কোঅর্ডিনেশন কমিটির (এনজেসিসি) যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠানে দেশের বর্তমান বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সূত্রিতায় ৩৩ লাখ মামলা এখনো বিচারের অপেক্ষায়। কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির তুলনায় বিচারাধীন মামলার আসামির সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত। তদন্তকারী সংস্থা, কারাকর্তৃপক্ষ, চিকিৎসকসহ বিচার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে অসমন্বয় এজন্য দায়ী।
যুক্তরাজ্য, নেপাল, ফিলিপিন্স এবং নিউজিল্যান্ডের বিচার সমন্বয় সংস্থাগুলোর উদাহরণ সামনে রেখেই মূলত জাতীয় আইন ও বিচার সমন্বয় কমিটির যাত্রা।
অনুষ্ঠানে মামলাজটে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি এবং কারা কর্তৃপক্ষের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন কারা মহাপরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন।
তিনি বলেন, দেশের কারাগারগুলোকে শাস্তি দেয়ার কেন্দ্র না করে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ার প্রচেষ্টায় সবচেয়ে বড় বাধা মামলাজট। কারাগারগুলোতে বর্তমানে মোট ধারণক্ষমতা ৩৬ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু সর্বশেষ হিসাব বলছে বন্দির সংখ্যা ৭৯ হাজারেরও বেশি।
‘এই বন্দিদের বেশির ভাগই বিচারাধীন মামলার আসামি। তাদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু কমছে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির সংখ্যা সে তুলনায় নগন্য। সংশোধনের জন্য যেসব পদক্ষেপ সেগুলো মূলত সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের জন্য। তাই কারাগারে থাকা বিচারাধীন মামলার আসামিদের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা দেয়া যাচ্ছে না।’
বিচারাধীন মামলার আসামিকে নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিবন্ধকতা জানিয়ে ইফতেখার উদ্দিন বলেন: অনেক সময় একই আসামির নামে দেশের ভিন্ন ভিন্ন জেলায় মামলা থাকে। ভিন্ন ভিন্ন জেলার আদালতে বিচার চলে। আসামি নিয়ে যেতে সমস্যা হয়। আবার অনেক সময় বিচারকের অসুস্থতায় মামলার বিচারের তারিখ পরিবর্তন হয়।
তিনি আশা করেন, এনজেসিসি’র মাধ্যমে দেশের মামলাজট দূর হবে এবং কারাগারে স্বস্তি আসবে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদিপ্ত মুখার্জি বলেন: যেখাতে বিভিন্ন রকম অংশীজন অর্থাৎ নানা পক্ষ জড়িত থাকে সেখানে সমন্বয় অত্যাবশ্যক।সাধারণ মানুষের মনে আইন-বিচারের প্রতি আস্থার জন্য সঠিক সময়ে সুবিচার দরকার। মামলা জটিলতা দূর করতে বাংলাদেশে এনজেসিসির যাত্রা শুরুর দিনটিকে তাই ঐতিহাসিক দিন বলা যায়। এর অংশ হতে পেরে ইউএনডিপি গর্বিত।
‘সব নাগরিকের জন্য ন্যায়সঙ্গত বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার দেয়া একটি লক্ষ্যমাত্রা। কারণ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে আন্তরিক বাংলাদেশ। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার ১৬ নম্বরে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।’
প্রধান অতিথি হিসেবে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন: সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা থাকলেও সামরিক শাসনে এই পরম চাওয়া পূরণ হচ্ছিলো না। ২০০৭ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে অবশেষে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আসে। কিন্তু দেখা যায় বহু মামলাজট বেঁধে আছে। বলা হয় জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড। তারপরও মানুষ ন্যায় বিচারের আশায় আদালতের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।
‘এই জটের পেছনে কয়েকটি সমস্যা ছিলো। সেগুলোর মধ্যে আদালতের অবকাঠামোগত সমস্যা, বিচারকদের অপ্রতুলতার মতো বাধা সরকার দূর করতে পেরেছে। মামলাজটের জন্য বিচার সংশ্লিষ্ট সংস্থা-পক্ষগুলোর সুষ্ঠু যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। পক্ষগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা, যোগাযোগের অভাবে মামলা নিষ্পত্তি পিছিয়ে যায়।’
সরকারের ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে জনগণের জন্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে একটি টেবিলে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মামলাজটের কারণ সনাক্ত করা হবে এবং জট দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এনজেসিসি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাজ্যের ক্রিমিনাল জাস্টিস বোর্ড, নেপালের জাস্টিস সেক্টর কোঅর্ডিনেশন কমিটি, ফিলিপিন্সের জাস্টিস সেক্টর কোঅর্ডিনেটিং কাউন্সিল এবং নিউজিল্যান্ডের জাস্টিস সেক্টর লিডারশিপ বোর্ডের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়েছে বলে জানান আইন ও বিচার বিভাগের যুগ্ম সচিব উম্মে কুলসুম।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. মোহাম্মদ জাকির হোসাইন, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হক প্রমুখ।