রাষ্ট্রীয় ভাবে আজও উপেক্ষিত বীরত্ব গাথা ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম
আসাদুজ্জামান সাজু, লালমনিরহাট
“চোখের আড়াল হলে, মনেরও আড়াল হয়” আর এই কথাটিই যেনো বাস্তব সত্য। আড়াল হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির নাম ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম। ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে যার ভুমিকা বীরত্ব গাথা। তিনি দেশের এক মাত্র মহান বীর যিনি জন প্রতিনিধি না হয়েও ১৬ শত মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পাশাপাশি এক লাখ শরর্ণাথীর থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ছিলেন হাতীবান্ধা আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম কমিটির প্রথম সম্পাদক। ছিলেন তৎকালীন রংপুর জেলা আওয়ামীলীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও মহান এই বীর পুরুষের খোঁজ কেউ রাখেনি। অথচ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় বৃহত্তর রংপুরকে নিয়ে ভারতের শীতলকুচিতে অবস্থিত নর্থ জোনের যুব প্রশিক্ষণের প্রধান ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় লালমনিরহাটের সাথে বুড়িমারী স্থল বন্দরের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের লক্ষ্যে কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ভাকারি ব্রীজ উড়িয়ে দেয়ার সেই দুঃসাহসীক অভিযানের নায়ক ছিলেন তিনি। কিন্তু স্বাধীনতা কিংবা বিজয় দিবসের মতো রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে এখন আর ডাক পড়ে না মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলামের। আর সেই বীর পুরষ ব্যক্তিটি আজও উপেক্ষিত স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। হয়ত তার জীবনের শেষ বেলায় বেলা শেষে অস্ত যাওয়া সূর্যের মত লালনের সেই কথাটি সত্য হবে “সময় গেলে সাধন হবে না”। আমরা কি পারি না ? এই বীর পুরুষের স্বর্ণ খচিত সময় গুলোকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিলিয়ে দিতে। স্থানীয় একটি শিশু নিকেতনের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নাতি-নাতনিদের নিয়ে সময় পার করছেন ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম।
সুত্র মতে, ১৯৭১ সাল, নজরুল ইসলাম রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শেষ বর্ষের ছাত্র। সহপাঠিদের নিয়ে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৩ মার্চ বাংলার পতাকা তোলেন তিনি। শতাধিক ছাত্রের মিছিল নিয়ে ঢুকে পড়েন রাজশাহী শহরে। মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। গুলিতে কয়েকজন নিহত হয়েছিল। বন্ধ হয় কলেজ। ৫ মার্চ বাধ্য হয়ে ফিরে আসেন নিজ বাড়ি হাতিবান্ধায়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষন একদিন পর ৮ মার্চ রেডিওতে শুনতে পান নজরুল ইসলাম। ৯ মার্চ হাতীবান্ধা ডাকবাংলো মাঠে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন হয় তার নেতৃত্বে ও হাতীবান্ধা সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারি হন। ২৭ মার্চ বৃহত্তর রংপুরের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে পার্শ্ববর্তী ভারতের কোচবিহার জেলার শীতলকুচিতে প্রবেশ করে জনসংযোগ শুরু করেন নজরুল ইসলাম। সেখানে আসতে শুরু করে রংপুর দিনাজপুরের লাখো শরণার্থী। সেই জোনে নজরুল ইসলামকে ইনচাজ করা হয়। রাজাকাররা তখন তার মাথার বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করেছিল ১ লক্ষ টাকা। ২৩ ডিসেম্বর নর্থজোনের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান স্বাক্ষরিত সনদে বলা হয়েছে, যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের কোচবিহারের শীতলকুচিতে ইয়ুথ ক্যাম্পে এক হাজার ছয়শ’ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছেন নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলাম শুধু মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেই কাজ করেননি। তার স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারতে প্রায় এক লাখ শরণার্থীর থাকার জায়গাসহ রেশনের ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। বিস্ফোরণ বিষয়ে মাত্র দুই ঘন্টার প্রশিক্ষণ নিয়েই রণাঙ্গনে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেলপথের ভাকারী ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়ার অভিযানে নেতৃত্ব দেন তিনি।
সে দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ৭০ বছর বয়সী ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালের জুন মাসে শীতলকুচি ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে ভারতীয় ফুলবাড়ি ক্যাম্পে হঠাৎ ডাক পড়ে তার। উদ্দেশ্য পাক সেনাদের প্রবেশে বাঁধা দিতে লালমনিরহাটের ভোটমারী ও বড়খাতা এলাকায় রেলপথের দুটি ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়া। তার সাথে থাকা বিস্ফোরক দ্রব্য ও অস্ত্র দু’টি মহিষের গাড়িতে করে পাঠান ঘটনাস্থলে। রেলব্রীজে ডিনামাইন্ড সেট করা হয়। শুক্রবারের জুম্মার নামায শেষে বিকট শব্দে উড়ে যায় ভোটমারীর ভাকারি রেলব্রীজ। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রেলপথ।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ-এই চার মূলনীতি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু এই চার মূলনীতি আজও সফল হয়নি। অনৈক্যই আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা।