ঈদকে সামনে রেখে গ্রাম বাংলার কামারপল্লীতে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে
এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট
আসন্ন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগেরহাটেরগ্রাম বাংলার কামারিরা।কামার পাড়ায় রাতভর টুংটং শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রসারে ও বহুমাত্রিক সমস্যার কারনে গ্রাম বাংলার সেই কামার শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কারও চোখে ঘুম নেই।
দিন রাত সমানভাবে কাজ করছেন তারা। কোরবানি উপলক্ষে কামারপট্টি গরম লোহা পেটানোর শব্দে মুখরিত। হাটে বাজারে বা বাড়ির পাশে, রাস্তার ধারে বসবাসকারী লোকজনের ঘুম ভাঙছে কামারদের লোহা পেটানোর শব্দে। আর মাত্র দু’দিন বাকী পবিত্র ইদুল আজহার। কোরবানির পশু জবাই ও মাংস বানাতে ছুরি, চাপাতি, দা, বটি ও কুড়াল খুব দরকার। কোরবানির আগে এ সব উপকরণ হাতের কাছে না থাকলেই নয়। সেগুলো সংগ্রহ ও প্রস্তুত রাখতে সবাই ব্যস্ত।
এগুলো নতুনভাবে তৈরি ও শান দেওয়ার জন্য বাগেরহাট জেলার নয় উপজেলাসহ ৭৫াট ইউনিয়ন কেন্দ্রিক বাজারের কামার শিল্পীরা এখন সবাই ব্যস্ত।এসময়টাতে তাদের আয়রোজগারও ভালো হয়। তবে কয়লা সঙ্কট আর আধুনিকায়নের ফলে বিলুপ্তির পথে যেতে চলেছে কামার শিল্প। লোহার তৈরী ছুরি, কাচি, কুড়াল, দা-বটির পরিবর্তে ষ্টেইনলেস ষ্টিলের তৈরী বিদেশী আধুনিক গৃহসামগ্রী বাজার দখল করেছে। ফলে এ শিল্প এখন চরম হুমকির মুখে।
সরেজমিনের ঘুরে দেখা যায়, কামারদের দম ফেলানোর সময় নেই এখন। একের পর এক ক্রেতা এসে দোকানে ভিড় করছে। ফলে সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার কোনরকম দোকানে বসেই খেতে হয়। কামার ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দু’টি দা, একটি বটি ও একটি ছুরিতে শান দেওয়া বাবদ দু’শত টাকা রাখছেন।
অন্য সময় হলে এগুলোর মূল্য ছিল এক’শত টাকা। সন্ন্যাসী বাজারের কামারিরা বলেন, বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে কোরবানির সময় কাজ বেশি হয়। তাই দামও একটু বেশি। যে কারণে অন্য সময়ের চেয়ে এখন আয় অনেক ভাল। তারা আরও বলেন, লাভ ক্ষতি যাই হোক পেশা টিকিয়ে রাখার জন্য সবাই আমরা কাজ করছি।
বাগেরহাটের ফয়লা বাজারের বিক্রেতা ইমান আলী বলেন, ঈদের দিন ঘনিয়ে আসায় বিক্রি আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিভিন্ন এলাকার কামাররা তাদের দোকানে এসেই এ সব সরঞ্জামাদি বিক্রি করে যায়। প্রয়োজনে তারা নিজেরাও কামার শালায় গিয়ে সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। এদিকে ঈদ উপলক্ষে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কোরবানির একটি ছোরা ৩৫০ থেকে ৪’শ, বিভিন্ন সাইজের চাকু ৩০ থেকে ১’শ, বটি ১’শ থেকে ৩৫০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
তবে দাম আরও বাড়বে বলে তারা জানান।স্থানীয় কর্মকার কালা চাদ দাস বলেন, না পারি ছাড়তে, না পাড়ি চালাতে, লোহা ও কয়লার দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকার বেশি আয় করা সম্ভব হয় না। পেটের দায়ে এখনও পড়ে আছি এ পেশায়। অন্য কাজতো আর পারি না, বাপ-দাদার এই পেশাও ছাড়তে পারি না, ছাড়লেও চলতে পারব না।
বর্তমানে বেশিরভাগ কামররাই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে কেউ কৃষি কাজ করে, কেউ ভ্যান চালায়, কেউ ইটভাটা ও ধানের চাতালে কাজ করছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে বাপ-দাদার দেয়া এই পেশায় আছি। অন্য কোনো কাজ তেমন করতে পারি না।
তিনি বলেন, তবে বর্তমানে লোহা ও কয়লার যে রকম দাম বাড়ছে তাতে আমিও হয়তো আর বেশিদিন এই কাজ করতে পারব না। তাই এই কাজ ছেড়ে তিনি মাঠে কৃষি কাজ করবেন বলে জানান।
কামারিরা বলেন, সরকারিভাবে সহজশর্তে আর্থিক সহযোগিতা না থাকায় লোহা, ইস্পাত ও কয়লার মূল্য বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে এ শিল্প দিন দিন পঙ্গু হয়ে পড়ছে। হাট বাজারে সরঞ্জামের চাহিদা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উৎপাদন খরচ উঠছে না। তাছাড়া এ সব দ্রব্য তৈরির জন্য প্রচুর পুঁজির দরকার, যা তাদের নেই। বাড়তি পুঁজির যোগান দিতে গিয়ে গ্রাম্য মহাজন ও ফড়িয়াদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে কোন কোন সময় ব্যবসায় তাদের লোকসান দিতে হচ্ছে।
কামারিরা আরও বলেন, বছরে একবার অর্থাৎ কোরবানি ঈদে আমাদের দা, বটি, ছুরি ও চাকু বিক্রি হলেও আমাদের সারা বছরের সংসার চলে না। আমরা চাই কোরবানির ঈদের মত সারা বছর আমাদের তৈরি পণ্য বিক্রি করতে।এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কামারদের মাঝে খনিজ কয়লার সরবরাহ নিশ্চিত করা হলে একে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে দাবি করেন তারা।