ঈদ উপলক্ষে ঐতিহাসিক দিবর দীঘিতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভির
মাসুদ রানা , (নওগাঁ )
পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে ঐতিহাসিক দিবর দীঘিতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভির ছিল লক্ষনীয় ।পতœীতলা উপজেলা নওগা জেলার সব দিক থেকে উন্নত হলেও বিনোদন কেন্দ্রের দিক থেকে পিছিয়ে আছে এখনোও ,পার্শবর্তী উপজেলা সাপাহারে জবই বিল, ধামুইরহাটে আলতাদিঘী ,বদলগাছীতে পাহাড়পুর ।
পতœীতলা সদর আত্রাই নদীর চরে নজিপুর পৌর পার্ক থাকলেও তা বর্ষার সময় নদীর পানিতে তলিয়ে যায়,সারা বছর এর প্রবেশমূল্য ফ্রি থাকলেও বছরের বিশেষ দিনগুলিতে পার্কের উন্নয়নের নামে প্রবেশ মূল্য আদায় করা হলেও তেমন কোন উন্নয়ন চোখে পড়ে না, তাই অত্র এলাকার মানুষের প্রধান বিনোদন কেন্দ্র হচ্ছে দিবর দিঘী ।
ঈদের দিন বিকাল থেকে দর্শনার্থীদের ভির ছিল দেখার মতো ,শুধু এলাকারই নয় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন আসছে এই ঐতিহাসিক দিঘীটি দেখতে ,ঈদের ২য় দিন নেত্রকনা থেকে দেখতে আসা দর্শনার্থী রাজু আহমেদ বলেন আমাকে ভাল লাগছে তবে এই দিঘীর সাথে যদি একটি র্পাক থাকতো বা যাদুঘর তাহলে আরও ভাল হতো । প্রতি বছরের ন্যায় ঈদ উপলক্ষে মেলা বসেছে এবং অনেক লোকের সমাগম ঘটেছে।
নওগাঁ জেলার পতœীতলা উপজেলার ঐতিহাসিক দিবর দীঘি সঠিক উদ্যোগ নিলে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে । ঐতিহাসিক দিবর দীঘিতে স্থাপিত প্রচীন স্থাপত্য পুরা কির্তীর অনুপম নিদর্শন এবং হাজার বছরের বাংলা ও বাঙ্গালীর শৌর্য-বীর্জের প্রতীক হিসাবে কালের ভ্রুকুটি উপো করে আজো দন্ডায়মান দীঘির বিজয় স্তম্ভটি আর সেটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী দিবর দীঘিতে ভীড় জমাচ্ছে ।
ইতিহাস সমৃদ্ধ দিবর দীঘি বরেন্দ্র ভূমি নওগাঁ জেলার পতœীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নের দিবর বা ধীবর নামক গ্রামে অবস্থিত। দীঘিটিকে ঘিরে লোক মুখে অনেক গল্পকাহিনী বা কাল্পনিক গল্প-কথা প্রচলিত আছে। এলাকার প্রবীন ব্যক্তিদের মতে জৈনক বিষু কর্মা নামক এক বির কর্তৃক এক রাতে এবং অন্যান্যদের মতে জীনের বাদশাহর হুকুমে এক রাতে বিশাল আকৃতির এই দীঘিটিকে খনন করা হয়। তবে যুগ যুগ ধরে লালিত ঐসব গল্পের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
আমরা ভবিষ্যতকে নিয়ে যখন ব্যাস্ত তখন আর অতীতকে খুঁজে দেখা হয়নি। আজ অবধি সঠিকভাবে জানা যায়নি দেশের কোন কৃতি সন্তান এই প্রাচীন দীঘি ও স্তম্ভটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
ইতিহাস থেকে জানা গেছে, দিবর বা ধীবর নামে পরিচিত এই বৃহত জলাশয় ও জলাশয়ের মাঝখানে অবস্থিত স্তম্ভটি একাদশ শতাব্দীর কৈবত্য রাজা দিব্যক তার ভ্রাতা রুদ্যোকের পুত্র প্রখ্যাত নৃপতি ভীমের কির্তী হিসেবে পরিচিত। ইতিহাস থেকে আরোও জানা যায়, পাল রাজা দ্বীতিয় মহিপালের (১০৭০ খ্রীঃ-১০৭১ খ্রীঃ) অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বরেন্দ্র ভূমির অধিকাংশ অমত্য পদচ্যুত সেনাপতি বরেন্দ্র ভূমির ধীবর বংশদ্ভুত কৃতি সন্তান দিব্যকের নেতৃত্বে পাল শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় মহিপালকে হত্যা করেন। পরে সর্বসম্মতিক্রমে দিব্যককে বরেন্দ্রভূমির অধীপতি নির্বাচন করা হয়।
অল্প কাল পরে দিব্যক মৃত্যু বরণ করলে প্রথমে রুদ্যোক পুত্র ভীম সিংহাসনে আহরোণ করেন। তিনিই এক মাত্র কৈবত্য বংশীয় রাজা যিনি প্রায় ২৫/৩০ বছর বরেন্দ্র ভূমি শাসন করেন। পরে দ্বিতীয় মহিপালের ভ্রাতা রামপাল ভীমকে পরাজিত ও নিহত করে রাজ্যা পুনঃউদ্ধার করেন। তবে কোন কৃতি কৈবত্য রাজা বিজয় স্তম্ভটি নির্মান করেছিলেন তা আজ অবধি সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে স্যার আলেকজ্যান্ডার কনিংহামের মতে সৌর্যদের পরে এ ধরনের কোন পাথরের কাজ বাংলার অঞ্চলে আর নির্মিত হয়নি।
সে ভিত্তিতে প্রতœতত্ববিদ আঃ কাঃ জাকারিয়ার মতে বিজয় স্তম্ভটি খ্রীষ্ট পূর্ব তৃতীয় শতকে নির্মিত হওয়া সম্ভব।
কি এই বিজয় স্তম্ভ: প্রায় ৩০ফুট লম্বা একটি অখন্ড পাথর কেটে তৈরী এই স্তম্ভের ৯টি কোণ আছে। এর এক কোণ থেকে অপর কোণের দুরত্ব ১২ ইঞ্চি। এই বিজয় স্তম্ভের উপরিভাগে পর পর তিনটি বলয়াকারে স্মৃতি রেখা আছে যা স্তম্ভের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এর শীর্ষদেশ নান্দনিক কারুকার্য খচিত মুকুটাকারে নির্মিত। বর্ণনা মতে পানির উপরিভাগে স্তম্ভের উচ্চতা ১০ ফুট, পানির ভিতর ১০ ফুট এবং মাটির নিচে সম্ভবত আরো ১০ ফুট গথিত আছে। স্যার বুকানন হ্যামিলটনের মতে স্তম্ভের দৈর্ঘ ৩০.৩৪ ফুট।
অপর দিকে স্যার আলেক জ্যান্ডার কানিংহামের মতে দৈর্ঘ ৩০ ফুট। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে যখন এই দীঘি পরিদর্শনে আসেন তখন এর গভিরতা ছিল ১২ ফুট এবং এর প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ ছিল ১২শ ফুট। বিজয় স্তম্ভটির শীর্ষদেশে মূল্যবান বস্তু আছে ভেবে কয়েক যুগ পূর্বে এর শীর্ষদেশের তি সাধন করা হয়েছে। কথিত আছে তারা প্রত্যেকে দিঘীতে ডুবে মারা গেছেন। যুগ যুগ ধরে দখলবাজদের কারনে দিবর দিঘীর অনেক সরকারী সম্পত্তি বেদখল হয়েছে। বর্তমানে দিবর দীঘির জলাশয়ের পরিমান প্রায় ২০ একর। এ জলাশয় টুকুই সরকারী সম্পত্তি হিসেবে বজায় আছে। মাছ চাষের জন্য লিজ দিয়ে সরকার প্রতি বছর দীঘি থেকে প্রয়ি ১০ ল টাকা রাজস্ব আয় করছে। যুগ যুগ আগে থেকে দিঘীর পাড়ে প্রতি বছর চৈত্র মাসে হিন্দু স¤প্রদায়ের বান্নির মেলা বসত, এখনো বসে।
সে সঙ্গে ২০০০ সালের দিক থেকে দিবর ইউপির তৎকালিন ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান ও বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মাষ্টার দিঘীতে দর্শনার্থীদের আগমন বাড়াতে প্রতিবছর দুই ঈদের দিন ও তার পরবর্তী ৭ দিন সেখানে ঈদের আনন্দ মেলার আয়োজন করে আসছেন। এতে করে মেলার ঐ দুই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ল ল লোকের সমাগম ঘটে। সে সময় দিবর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান ও স্থানীয় সংসদ সদস্যর সহযোগীতায় দবির দিঘী উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
এই প্রকল্পের আওতায় দিঘীতে মাটি কাটানো সাপাহার-নওগাঁ সড়ক থেকে দিঘী পর্যন্ত প্রায় দেড় কি: মি: রাস্ত পাকা করন, দিঘীর পাড়ে অতিথি বিশ্রামাগার, মসজিদ, টয়লেট, টিউবয়েল, একাধিক সেড স্থাপন ও ফুলের বাগান স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া সে সময় চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান সম্পূর্ন ব্যক্তিগতসেখানে একটি মিনি চিড়িয়াখানা স্থাপন করেন। এই মিনি চিড়িয়াখানায় বিভিন্ন প্রজাতীর দেশীয় পশু পাখী রাখা হয়েছে। এই সব পশু পাখীর খাদ্যা চিকিৎসা সহ যাবতীয় খরচ তিনিই আর ব্যক্তিগত খরচে করে থাকেন বলেও জানা গেছে। এ সব ব্যায় ভার বহন করতে অনেক সময় তাকে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে।
দিবর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ বলেন, বর্তমানে ঐতিহাসিক এই দিবর দিঘীতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বনভোজন ও ভ্রমনের উদ্দেশ্যে শত শত মানুষের সমাগম ঘটে। প্রতি ঈদের দিন থেকে পরের ৭ দিন থেকে ১০ দিন দীঘির পাড়ে যে মেলা বসে তাতে প্রতিদিন অর্ধ লাধিক মানুষের আগমন ঘটে। প্রকৃতির অপরুপ নয়নাভিরাম এই দিঘীর চতুর্দিকে রাজশাহী সামাজিক বনবিভাগ কর্তৃক বিস্তীৃন এলাকা জুড়ে রয়েছে কৃত্রিম বন যা দিঘীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ছায়া সুশীতল মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছ।
দলমত নির্বিশেষে হাজারো মানুষের দাবী হাজার বছরের বাংলা ও বাঙ্গালীর সৌর্য-বীর্যের প্রতীক এবং প্রাচীন পুরা কীর্তির অনুপম নিদর্শন ঐতিহাসিক দিবর দিঘী ও বিজয় স্তম্ভটি রায় দিবর দিঘীকে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হোক। দীঘি লিজ দিয়ে প্রতি বছর যে রাজস্ব আয় হচ্ছে তা দিয়েই যদি পর্যটকদের সুজগ সুবিধা বৃদ্ধির কাজে লাগানো হয় তাহলে সরকারকে আলাদা করে কোন প্রকল্প হাতে না নিলেও দিবর দীঘিতে পর্যটক বাড়বে। এতে সরকারের যেমন রাজস্ব বাড়বে, তেমনি এলাকার মানুষ পাবে সারা বছর নির্মল বিনোদনের মাধ্যম।