ধূমপানমুক্ত ভুটান বিশ্ববাসীর জন্য অনুসরণীয়
হোটেলের রিসিপশন থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট, শপিং মলের লবি পর্যন্ত সর্বত্রই ইংরেজিতে লেখা ‘নো স্পোকিং প্লিজ’। এটি অনুরোধের ভাষা হলেও তা অমান্যে মোটা অঙ্কের অর্থদণ্ড গুনতে হয়। সম্পূর্ণ ধূমপানমুক্ত ভুটানে পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলে কঠোর শাস্তির শিকার হতে হয়। এখানে প্রকাশ্যে তামাকদ্রব্য বিক্রি ও সেবন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোনো দোকানেই সিগারেট কিংবা তামাকদ্রব্য কিনতে পাওয়া যায় না। তবে পর্যটকরা দ্বিগুণ শুল্ক পরিশোধ করে সিগারেট সঙ্গে আনতে পারেন। কিন্তু তা সেবন করতে হবে হোটেল রুম কিংবা বাথরুমের ভিতরে।
অলিগলিতে পানশালার অভাব নেই। কিন্তু ভুটান কঠোরভাবে তার দেশের জনগণের ধূমপানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। পর্যটকরাও তা অনুসরণ করছে। ফলে প্রায় ৮ লাখ মানুষের এই দেশটিতে ধূমপান খাতে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে না তাদের। উপরন্তু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বেঁচে যাচ্ছে বিপুল অর্থ। অথচ জনবহুল আমাদের দুই দেশ বাংলাদেশ ও ভারতে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে সিগারেটের পেছনে।
ভুটানের ফুটসোলিংয়ে হোটেল নামগের রিসিপশনিস্ট পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের মানিক দাস বললেন, এখানে প্রকাশ্যে কেউ সিগারেট খায় না। দোকানে বিক্রিও হয় না। পাবলিক প্লেসে সিগারেট খেলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা। তিনি বলেন, যাদের সিগারেট ছাড়া চলেই না তারা হোটেলের স্টাফ বা স্থানীয়দের মাধ্যমে কঠোর গোপনীয়তায় কিনতে পারেন। তবে তার জন্য অনেক বেশি অর্থমূল্য দিতে হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কয়েক বছর আগের এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে তামাক সেবনের ফলে জনগণ যেসব রোগে আক্রান্ত হয় তার চিকিৎসা বাবদ বছরে প্রায় ৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। অন্যদিকে তামাক খাতে সরকার বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা আয় করে। বাংলাদেশে সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের বাজারটি বর্তমানে কমবেশি ২৫ হাজার কোটি টাকার। এদিকে সম্প্রতি জাপানের বৃহত্তম ও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সিগারেট প্রস্তুতকারক জাপান টোব্যাকো প্রায় ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে বাংলাদেশের আকিজ গ্রুপের সিগারেট তৈরির সব ব্যবসা কিনে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি ঢাকায় দুই কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তিও সই হয়ে গেছে।
সেই চুক্তির সুবাদেই জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমপক্ষে ১ কোটি ৮০ লাখ এবং সংখ্যাটি ক্রমেই বাড়ছে। জাপান টোব্যাকো নিজেরাই এক বিবৃতিতে বলছে, বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম সিগারেটের বাজার এবং এ বাজার প্রতি বছর ২ শতাংশ করে বাড়ছে। সুতরাং সিগারেট খাতে মুনাফার এমন সুযোগ ও সম্ভাবনা পৃথিবীর খুব কম দেশেই রয়েছে বলে তারা মনে করছে। রাজস্ব আয়ের একক বৃহত্তম খাত এটি। সর্বশেষ গ্লোবাল টোব্যাকো সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪ কোটি ১৩ লাখ (৪৩.৩%) তামাক সেবন করে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে বিশ্বে প্রতি ৬ দশমিক ৪ সেকেন্ডে একজন লোক মারা যায়। আগামী ২৫ বছরে তামাকের কারণে বিশ্বে ২৫ কোটি শিশু-কিশোরের মৃত্যু হবে। বর্তমানে বেশি বয়সীদের মধ্যে ১১০ কোটি মানুষ ধূমপান করছে।
এই ধূমপায়ীর প্রায় ৮০ শতাংশ হলো নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে ৫৭ হাজারের বেশি মানুষ তামাকের ব্যবহারজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে এবং ৩ লাখ ৮২ হাজার পঙ্গু হয়। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠী ও বিড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি থেকে বোঝা যায় ভবিষ্যতে তামাকজনিত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে। তামাকমুক্তির সংগ্রামে ভুটানই একমাত্র দেশ যাকে অনুসরণ করতে পারে সারা বিশ্ব। এদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন এবং ‘সুস্থ জাতি’ গড়তে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক নির্মূলের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালে ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর স্পিকারদের সম্মেলনে এ প্রত্যয় প্রকাশ করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, যদিও আমরা তামাক নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি, কিন্তু আমরা এ নিয়ে কোনো আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। আমরা আশা করি, ২০৪০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার নির্মূল করা সম্ভব হবে। বিভিন্ন তৎপরতার কারণে বর্তমানে সিগারেট সেবনকে বাংলাদেশে সামাজিকভাবে ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয় না।