কালীগঞ্জের সফল মৎস্য চাষী প্রভাত গমেজ
লোকমান হোসেন পনির, কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি
প্রভাত যোহন গমেজ। দীর্ঘ ১৩ বছর কঠোর পরিশ্রম করে প্রভাত এখন সফল মৎস্য চাষী। এলাকায় তিনি এখন পরিচিত মুখ ও সফল মৎস্য চাষী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। গড়ে তুলেছেন গমেজ এগ্রো ফিশারিস নামে একটি মৎস্য খামার। প্রতিবছর মাছ চাষ ও বিক্রি করে ৮-৯ লাখ টাকা আয় করছেন। প্রভাত যোহন গমেজ (৪৫) কালীগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া ইউনিয়নের পিপড়াসৈর গ্রামের নিক্লেস গমেজের ছোট ছেলে।
এইচএসসি পাস করে বিভিন্ন চাকরির সুযোগ হলেও অন্যের অধীনে কাজ করতে তার ভালো লাগতো না। জীবনকে গোছাতে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য মালদ্বীপ পাড়ি দিলেও সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেনি তিনি। শূন্য হাতে দেশ ফিরে আসে প্রভাত। বাবা নিক্লেস গমেজ ও বড় ভাই এন্ড্রো গমেজ তাকে দেশে কিছু করার জন্য তাগিদ দেয়।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, প্রভাত নিজে স্বালম্ববী হওয়ার জন্য ২০০৪ সালে সাভারে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তিন মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে এসে ছোটখাটো লেয়ার মুরগীর খামার শুরু করেন। ২০০৫ সালে ৭৫ হাজার টাকা নিয়ে আড়াই শত লেয়ার মুরগী নিয়ে পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করেন। দুই বছর পোল্ট্রির ব্যবসা করে ২০০৭ সালে ৬ বিঘা পৈত্রিক সম্পত্তিতে ৮ টি পুকুর খনন করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করেন। এর মধ্যে উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস থেকে ৫০ হাজার টাকা ও উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে ৫০ হাজার টাকার ঋণ নেয় প্রভাত। স্থানীয় খ্রিস্টান সমবায় ঋণদান সমিতি থেকে ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পুরোদমে মাছ ব্যবসায় নিজেকে আত্মনিয়োজিত করেন।
৮টি পুকুরের পর আরো নতুন ৬টি পুকুর খনন করে ১৪ টি পুকুর নিয়ে তিনি নতুন উদ্যমে মাছ চাষ শুরু করেন। রুই, কাতল, তেলাপিয়া, শিং মৃগেলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। তিনি সিরাজগঞ্জ ও ব্র্যাক থেকে রেনু কিনে এনে নার্সারি থেকে কালচার পর্যন্ত মাছ উৎপাদন করে আসছেন।
পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে সাবমারসিবল পাম্পের মাধ্যমে পুকুরে পানি পূর্ণ করে থাকেন। সাড়ে ৪ একর সম্পত্তির উপর তার ১৪টি পুকুর রয়েছে। পাশাপাশি একটি গরু নিয়ে গরুর খামার শুরু করেন । এখন তার খামারে ১৩টি গরু রয়েছে। পুকুরের পাশে নতুন উদ্যমে তিনি ছাগল পালতে শুরু করেছে। ৬টি ছাগল ক্রয় করে খামারের কার্যক্রম শুরু করেছেন। প্রভাতের দুই ছেলে বড় ছেলে দিপ্ত গমেজ তুমুলিয়া বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে এবং ছোট ছেলে দৃক গমেজ স্থানীয় ফাদার উইল স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।
সফল মৎস্য চাষী প্রভাত যোহন গমেজ জানান, আগের তুলনায় এখন মাছ চাষে লাভ কম হয়। কারন হিসেবে তিনি মাছের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন। তার মতে, ২০০৭ সালে ৩৬ হাজার টাকা দিয়ে ১ টন খাবার কেনা যেতো। ওই খাদ্যের দাম এখন বেড়ে গেছে। বর্তমানে ১ টন মাছের খাবার কিনতে ৪৮-৫২ হাজার টাকায় গুনতে হচ্ছে। তাই আগের চেয়ে লাভ কম হচ্ছে। ২০০৮ সালে পাইকারী ১ কেজি কৈ ২২০ টাকা বিক্রি হতো। আর এখন কৈ বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকায়। রুই মাছ প্রতি কেজি ১৬০-১৮০ টাকা, শিং মাছ ৪০০-৪৫০ টাকা,কাতল ২৫০-৩০০ টাকা, তেলাপিয়া ১০০-১০৫ টাকা এবং মৃগেল ১২০-১৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। তিনি পাইকারী দরে স্থানীয় নাগরী, উলুখোলা, পলাশ, ঘোড়াশাল ও পূবাইলের মৎস্য ব্যবসায়ীদের নিকট খামার থেকে মাছ বিক্রি করছেন।
প্রভাত যোহন গমেজ ২০১৭ সালে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ সফল মৎস্য চাষি হিসেবে উপজেলা থেকে পুরস্কৃত হন। তার খামারে ৪ জন শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের খাওয়া দাওয়া তিনি বহন করেন। মাস শেষে শ্রমিকদের ২৪-৩০ হাজার টাকা দিতে হয়। তিন ভাইয়ের মধ্যে প্রভাত সবচেয়ে ছোট। তার কর্মে অনুপ্রানিত হয়ে এলাকার অনেক যুবক মাছ চাষের প্রতি মনোনিবেশ হচ্ছেন। ২০১৭ সালে নরসিংদী থেকে কিছু শিক্ষার্থীরা তার পুকুরের গলদা চিংড়ি চাষ দেখতে এবং উপযুক্ত পরামর্শের জন্য খামার পরিদর্শন করেছেন। একই বছর ঢাকা থেকে কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থীরা তার খামারের গলদা চিংড়ি চাষের কার্যপ্রণালী শিখতে খামার পরিদর্শন করেন।
সফল মৎস্যজীবী প্রভাত আরো জানান, মাছ ব্যবসায়ীদের নিকট যখন মাছ বিক্রি করেন তখন খামারের রাস্তা দিয়ে কোনো যানবাহন ঢুকে না। এই রাস্তা দিয়ে এলাকার ১শত পরিবারের লোকজন যাতায়াত করে প্রতিনিয়ত। কিন্তু রাস্তাটি সরু এবং মাটির। সংস্কারের অভাবে রাস্তাটির অবস্থা বেহাল। তাই অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়ে খামার থেকে মাছ নিয়ে চড়াখোলা মোড় পর্যন্ত মাছ এনে ট্রাক বা অন্যান্য যানবাহনে ভরতে হয়। ৪ শত গজ পর্যন্ত রাস্তাটি সংস্কার না করায় তার পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। তিনি রাস্তাটি সংস্কারের দাবি জানান। ঢাকা থেকে বা যেকোনো স্থান থেকে গমেজ এগ্রো ফিশারিসে আসতে হলে তুমুলিয়া মিশন নেমে রিকশাযোগে চড়াখোলা ফাদার উইল স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন পূর্ব পাশে সফল মৎস্য চাষী প্রভাতের খামারটির দেখা মিলবে।
কালীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. লতিফুর রহমান বলেন, প্রভাত যোহন গমেজ কালীগঞ্জের একজন সফল মৎস্য চাষী। সে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মাছ চাষ করে এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার কর্ম দেখে অনেক যুবকরা মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।