শিকড়ের সন্ধানে ডেনমার্ক দম্পতি পাবনায়
বিত্ত বৈভব আর প্রাচুর্যের মধ্যেও আমি সব সময় কেমন যেন একটি শূন্যতা অনুভব করতাম। আমি তাজা মাছের মতো পানির পরিবর্তে ডাঙ্গায় ছটফট করছিলাম। ৪১ বছর এমন যন্ত্রণায় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে অনেকের সঙ্গেই দুর্ব্যবহার করছি।
তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র না থাকলেও প্রাণের টানে নিজ বাবা-মা ও স্বজনদের খোঁজে আমার পাবনায় আসা। কথাগুলো সম্প্রতি শেকড়ের সন্ধানে পাবনায় আসা এক ড্যানিশ দম্পতির। মিন্টো কার্টসটেন সনিক (৪৭) মাত্র ছয় বছর বয়সে পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী ঘাট এলাকা থেকে হারিয়ে যায়। সেখান থেকে ঢাকার ঠাটারীবাজার এলাকার চৌধুরী কামরুল হুসাইন উদ্ধার করে রাজধানীর একটি শিশু সদনে আশ্রয় দেয় তাকে।
পরে সেখান থেকে ডেনমার্কের এক নিঃসন্তান দম্পতি মিন্টুকে দত্তক নিয়ে যায়। সেখানেই তার শৈশব-কৈশর কাটে, বিত্ত বৈভবের মাঝে লেখাপড়া শিখে বড় হয়। পেশায় একজন চিত্র শিল্পী। ডেনমার্ক নাগরিক এনিটি হোলমি হেব নামের এক চিকিৎসককে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ে। জীবনের শুরুতে তেমন সমস্যার সৃষ্টি না হলেও বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই সে সব সময় হীনমন্যতায় ভুগতেন।
পরিবারের লোকজনের সঙ্গে খুবই দুর্ব্যবহার করতেন। মাঝে মধ্যেই মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেত, কোনো কিছুই ভালো লাগত না। অবশেষে পরিবারের সিদ্ধান্তে ড্যানিশ স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ছোট বেলার একটি ছবিকে অবলম্বন করেই ছুটে আসে পাবনায়। ওঠেন শহরের একটি আবাসিক হোটেলে। ১০ দিন ধরে পাবনা শহরসহ নগরবাড়ী এলাকায় চষে বেড়াচ্ছেন এই দম্পতি নিজ বাবা-মা কিংবা স্বজনদের খোঁজে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মিন্টু ১০ দিনেও খুঁজে পায়নি তার আত্মীয়স্বজনদের। সকালে হোটেল কক্ষ থেকে বের হয়ে রাস্তায় রাস্তায় লিফলেট বিলি করছেন, নিজ স্বজনদের সন্ধানে।
মিন্টু বাংলায় কথা বলতে না পারলেও বুকে হাত রেখে বাবা-মায়ের কথা বোঝাতে চায় এবং তাদের সন্ধান চায়। তিনি বলেন, যদিও ডেনমার্কে আমার পালক পিতা-মাতা ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খুব সুখেই আছি, তবুও আমার অন্তর এখনো বারবার কেঁদে ওঠে বাংলাদেশের বাবা-মা ও তার স্বজনদের জন্য। মনে হয় তাদের পেলেই তার জীবনটা সম্পূর্ণ হয়ে ওঠবে। আমি চোখ বন্ধ করে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেই, মনে হয় আমার সেই স্বজনদের গন্ধ পাচ্ছি।
ছোটবেলায় বাংলায় হয়তো কথা বললেও পরবর্তীতে ভুলে গেছি, তবে এখন বাংলা ভাষা কানে এলে অন্যরকম এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। যা আমি প্রকাশ করতে পারছি না কিন্তু আমি বাংলা ভাষায় স্বপ্ন দেখি। তবে পরিবার ও শিকড় থাকা প্রত্যেকের জন্যই অতীব জরুরি বলেও মত দেন তিনি। কেননা এগুলো ছাড়া মনের ভিতরে অন্য রকম কষ্ট অনুভব হয়, যা অন্যদের বোঝানো যাবে না।
তিনি বলেন, আমি বর্তমানে ডেনমার্কে একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ কিন্তু আমি আমার অতীত জানি না, অভাব অনটন কী বুঝি নাই কখনো। আমি সব সময়ই খুঁজে ফিরছি আমার অতীতকে। তার ফেসবুক বন্ধু স্বাধীন বিশ্বাস বলেন, আমার সঙ্গে ফেসবুকে কথা হলে তাকে দেশে আসার অনুরোধ করলে সে দেশে আসে।
আমরা চেষ্টা করছি তার স্বজনদের খুঁজে বের করার জন্য। পাবনা ইভিনিং টাচ হোটেলের ব্যবস্থাপক ফারুক হোসেন বলেন, আমাদের এখানে ছয় দিন ধরে অবস্থান করছেন তারা। প্রথমে তারা বেড়ানোর কথা বলে হোটেলে উঠলেও এখন জানতে পারছি ওই ভদ্রলোক তার বাবা-মার খোঁজে ডেনমার্ক থেকে এসেছে। এ বিষয়ে পাবনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) শামিমা আকতার বলেন, বিষয়টি আমরা জেনেছি। পুলিশের পক্ষ থেকে যতটুকু সহযোগিতা করার করছি। ইতিমধ্যেই তিনি পাবনা সদর থানায় একটি এজাহারও করেছেন। তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দেশের গণমাধ্যমগুলোর মিন্টুর পাশে দাঁড়ানো দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।