বেনাপোলের শিশু শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু।চৌগাছা ট্রাজেডির ৫ বছর
শহিদুল ইসলাম,বেনাপোল প্রতিনিধি।
আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি। ভয়ালো চৌগাছা ট্রাজেডির ৫ বছর পূর্তি। ২০১৪ সালের এই দিনে বেনাপোলের গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিকনিক বাস খাদে পড়ে ৯ শিশু শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ৫ বছর আগে একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল বৃহত্তর যশোরসহ গোটা দেশের সঙ্গে বিশ্ববাসীকে। এই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ গোটা দেশকে সেদিন কাঁদিয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সেদিন প্রচারিত হয়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সড়ক দুর্ঘটনার করুণ কাহিনী। শিক্ষা সফরের বাস দুর্ঘটনার ঘটনাটি ছিল ২০১৪ সালের অন্যতম এক হৃদয়স্পর্শী ঘটনা।
যশোরের বেনাপোলের পিকনিকের বাস সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সেই ৯ শিশু শিক্ষার্থীর স্মরণে আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (১৫ ফেব্রæয়ারি) সকালে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আয়োজনে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এক বিশাল শোক র্যালী বের করা হয়।
উক্ত র্যালিটি নিহতদের স্মরনে বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে নির্মিত স্মৃতি স্থম্ভে যশোর-১ শার্শা আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিন ও সর্বস্তরের মানুষ ফুল দিয়ে নিহত শিশুদের স্মরন করেন। সকালে বেনাপোলের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
৮৫ যশোর-১ শার্শা আসনের মাননীয় এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের নেতৃত্বে উক্ত র্যালিতে উপস্থিত ছিলেন বীরমুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু, শার্শা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, শার্শা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান, উপজেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুর রব, শার্শা উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল, বেনাপোল পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব এনামুল হক মুকুল ,সাধারন সম্পাদক নাসির উদ্দীন, বেনাপোল ইউপি চেয়ারম্যান বজলুর রহমান, শার্শা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি অহিদুজ্জামান অহিদ, শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রহিম সরদার, সাধারন সম্পাদক ইকবাল হোসেন রাসেলসহ বেনাপোলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, বিভিন্ন সংগঠনের নেতা কর্মীরা এ শোক র্যালি তে অংশ গ্রহন করেন।
এ উপলক্ষে বেনাপোল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোরআন খতম ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব করেন ম্যানেজিং কমিটি’র সভাপতি মোঃ মজনুর রহমান।
উল্লেখ্যঃ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সাল। সে দিন ছিল শনিবার। যশোর জেলার শার্শা উপজেলার বেনাপোল গাজিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বার্ষিক শিক্ষা সফরের জন্য যায় ¯স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন ও শপথের স্মৃতিবিজড়িত মেহেরপুরের মুজিবনগর। ৩টি বাসযোগে বিদ্যালয়ের এসএমসির নেতৃবৃন্দসহ শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী মিলে প্রায় সাড়ে তিনশ’ জন এই পিকনিকে অংশগ্রহণ করেন।
সারাদিন বিরামহীন আনন্দে দিন কেটে যায় শিশু শিক্ষার্থীসহ সকলের। সন্ধ্যার আগেই তারা বেনাপোলের উদ্দেশে রওনা হন। বাসের মধ্যে ছোট ছোট শিশুদের নানা খুনসুটি আর আনন্দ চিৎকারের খেলা কিছুতেই যেন থামছে না, আবার অনেকে কিছুটা ক্লান্তি বোধ করে বাসের সিটেই ঘুমে আচ্ছন্ন।
সে দিন সন্ধ্যা থেকেই চৌগাছা এলাকায় রিমঝিম বৃষ্টি হয়। বাস ৩টি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা পার হয়ে চৌগাছা এলাকায় প্রবেশ করে। চৌগাছার ঝাউতলা নামক স্থানে পৌঁছালে রাজ মেট্রো-জ- ১১-০০৮০ নাম্বারের বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার দক্ষ
দক্ষিণ পাশে খাদে পড়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার। সমস্ত আনন্দ উল্লাস হঠাৎই থমকে যায়। শিক্ষার্থীরা যে যার মতো করে বাসের জানালা দিয়ে লাফিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করে। উদ্ধারের জন্য স্থানীয় কাঁদবিলা, মাঙ্গিরপাড়া, চাঁনপাড়া, গুয়াতলী গ্রামের সাধারণ মানুষ ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। কিন্তু ততক্ষণে ঘটনাস্থলেই সাত সাতটি শিশুর জীবন প্রদীপ চিরদিনের মতো নিভে যায়। আহত হয় আরো ৭০ জন শিশু শিক্ষার্থী ও ৩/৪ জন শিক্ষক। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ২ জন শিক্ষার্থী মারা যান।
ঘটনাস্থলে নিহতরা হলো, বেনাপোল পৌরসভার ছোটআঁচড়া গ্রামের সৈয়দ আলীর দুই মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সুরাইয়া (১০) ও তার বোন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী জেবা আক্তার (৮), একই গ্রামের ইউনুস আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী মিথিলা আক্তার (১০), রফিকুল ইসলামের মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী রুনা আক্তার মীম (৯), লোকমান হোসেনের ছেলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শান্ত (৯), গাজিপুর গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র সাব্বির হোসেন (১০) ও নামাজ গ্রামের হাসান আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী আঁখি (১১)।
১৩ দিন পর ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ছোট আঁচড়া গ্রামের মনির হোসেনের ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ইকরামুল (১১), সর্বশেষ দুর্ঘটনার ৩২ দিন পর ১৯ মার্চ ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় একই গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইয়ানুর রহমান (১১)।
দিন মাস পার হয়ে ফিরে এসেছে ৫ বছরের ঠিক এই দিনটি। কিন্তু ফিরে আসিনি হারিয়ে যাওয়া ৯ শিশু শিক্ষার্থী। আজো কাঁন্না থামেনি হারিয়ে যাওয়া এ সব শিশুদের পরিবারের। পথ চেয়ে বসে আছে এই বুঝি ফিরে আসছে তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানেরা।