ধর্ষিত বাংলাদেশ! নিরাপত্তা কোথায় ?
জুঁই জেসমিন,
বলতে পারেন নিরাপত্তা কোথায় ? যেখানে পালিত বাবার কাছে কিশোরী বিথী যৌন হয়রানির স্বীকার হয়ে বিষপান করে প্রাণ হারালো, যেখানে 'নুসরাত রাফি' পিতা তুল্য শিক্ষকের কাছে রক্ষা পায়নি ।
নিরাপত্তার মূল আশ্রয় যেখানে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির। সেখানে সেই পরিবার, প্রতিষ্ঠান, মন্দির, মসজিদে যৌন নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে শিশু থেকে নারী! কেন, কি কারণে এ জঘন্য ঘটনা গুলো ঘটছে ? সেটা তলিয়ে না দেখে দৈনন্দিন একটার পর একটা ঘটনার সূত্র ধরে বড় বড় ব্যানার ঝুলিয়ে চিৎকার করি মিছিলে মিছিলে- বিচার চাই, বিচার চাই, স্লোগানে।
অপরাধীর বিচার কার্য চলে টলে পড়া গরুর গাড়ির মতো।
সবার ভেতরে ভয় সৃষ্টি না হলে, দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন না ঘটলে, সচেতন না হলে, গুরু শিষ্যের মাঝে স্নেহ- শ্রদ্ধা না থাকলে, পরিবার বাবা মা সন্তানের মাঝে সুসম্পর্ক না থাকলে- এমন ঘটনা তো ঘটতেই থাকবে। আর এভাবে একটার পর একটা ঘটনা, এক এক শিরোনামে পাহাড়সম স্তুপে বিশ্বের মানচিত্রে আর এক শিরোনাম হবে যার নাম-
ধর্ষিত বাংলাদেশ!' এখনকার সমাজে ক'জন সন্তান বাবা মা'কে ভয় করে? করে না, বরং বাবা মায়েরাই সন্তানকে ভয় করে চলছে। এতে কি করে আশা করবেন ভাল কিছু? প্রশ্নেই আসে না।
বিশ বছর আগের কথা বলি, দেশে কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে, হাটে বাজারে হকারেরা খবরের কাগজ হাতে তুলে আওয়াজ করতো ঘটনার শিরোনাম সুরে, " আজকের গরম খবর, গরম খবর, তাজা খবর বলে- অমুক জেলার এক স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করেছে পড়ুন সবাই পড়ুন। বাপ দাদারা দু টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে আসতো বাজারের সাথে সেই কাগজ।
আর সবাইকে তা পড়ে শোনাতেন। অপরাধীর ফাঁসি বা জেল হলে, সেই কাগজটাও নিয়ে আসতেন। সবার মাঝে এক ভীতির কাজ করতো। ছিলো ভয়, ছিল শ্রদ্ধা, ছিলো বিবেক বোধ সে বেলার মানুষের। এখন দৈনন্দিন যা ঘটছে সেই নিরক্ষর যুগে তা এমনটি ঘটেনি। শিক্ষিত ও সভ্য সমাজে এমন ঘটনা ঘটা সত্যিই লজ্জাজনক !
সেকালে যার যার ঘরে রেডিও ছিল, তার ঘরে বেশ আসর জমাতো মানুষ, শুধু মাত্র দেশের খবরা খবর জানার জন্য। কান পেতে চোখ বুজে শুনতো রেডিওর খবর। আর এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন, হাতে হাতে ফোন । তারপরও জানি না দেশের খবর। ভয়, ভীতি, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান, দায়িত্ব সব, সব উঠে গেছে ব্যক্তি স্বার্থের দৌড় খেলায়। কোথায় আছি আমরা, আর কোথায় যাচ্ছি -? ভারী ভাবনা !
বাপ দাদার কথা বলছি না, আমার কথায় বলছি, স্কুলে গেলে শিক্ষকের চেয়ারে বসা তো দুরের কথা চেয়ারে হাত রাখার মতো সাহস ছিলো না কারও। স্যারদের প্রতি এতো ভয় আর শ্রদ্ধা ছিলো। যদি দেখি আমরা, প্রধান শিক্ষক আসছেন, সারা স্কুল সহ ভূমিকম্পের মতো কাঁপতো। আর এখন ক্লাসে শিক্ষক ও ছাত্রের মাঝে পার্থক্য নেই বললে চলে।
গুরু মানে -রক্ষকরায় ভক্ষক, আর শাসনকারীরাই শোষক হয়ে উঠছে! প্রাইভেট কি ? কোচিং কি ? এসব ছিলো না আগে।
অথচ আজকের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট কোচিং ছাড়া যেন অচল। সেই সকালে এক বস্তা বই ব্যাগে চেপে বের হয়, কোচিং স্কুল শেষ করে ফিরে সন্ধ্যা বা রাতে। আর স্মার্ট ফোন তো আছেই ছেলেমেয়ের হাতে যা সক্রিয়তা গ্রাসের বড় অস্ত্র। এতে ক'জনের ছেলেমেয়ে কতটা সুস্থ সবল, আপনারাই বলুন? সব অঙ্গনেই প্রকট ব্যবসা। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবসা, শিল্প সাহিত্যে ব্যবসা, চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবসা, ধর্ম নিয়েও ব্যবসা।
মানুষ অর্থ আর দেহ ভোগে ন্যস্ত, ঘুরছে প্রেম নামে নাগরদোলায়।
শিক্ষা গুরুর লোভাতুর মন, ছাত্রীর সাথে গড়ে তোলে নোংরা সম্পর্ক, করে ধর্ষণ করে খুন।
এই আজকের সমাজ, যার ভয়াবহ রূপের নকশা বিভৎস।
কেন আজকের সমাজ এমনটি ?
এর পিছনে একাধিক কারণ তো নিশ্চয় রয়েছে ...
১। বাবা মায়ের অবাধ্য ছেলেমেয়ে অসময়ে বিয়ে করে, করে সন্তান লাভ, আর সেই সন্তান বড় হয় দাদি বা নানির কাছে-
যেমন; গার্মেন্টসের শতকরা ৮০ ভাগ নারী কর্মীর শিশু সন্তান, বাবা মায়ের কাছে বড় হয়ে উঠে না, পায়না মৌলিক সোহাগ শাসন, নানু দিদার ঘরে শাসনশূন্য ভাবে নিজের মতো করে বেড়ে উঠে। যেখানে একজন শিশুর আলোকিত জীবন দানের মৌলিক নির্যাস বাবা মায়ের ছায়াতল। সেখানে শিশু বড় হতে থাকে যারতার কাছে। ভয় ও শ্রদ্ধা, যে শিশুর অন্তরে সৃষ্টি না হলো সেখানে বিবেকবোধ শব্দটা বাসা বাঁধবে কি করে? আদর এমন একটা জিনিস যা আবেগের আশ্রয় কেন্দ্র। আর আবেগের মাঝে বিবেক বিরাজমান না থাকলে জীবন নিশ্চিত ধ্বংস!
২। বেশির ভাগ বাবা মা সন্তানের দেখাশোনা পড়াশোনার দায়িত্ব দেন শিক্ষক ও বাড়ির মানুষ বা কাজের লোকেদের হাতে। এতে শিশু যৌন হয়রানির স্বীকার থেকে সকল অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ে হয়ে উঠে ভয়ংকর।
৩। সন্তান অমানুষ হওয়ার বড় কারণ বাবা মায়ের প্রক্রিয়া ও পরিবারের অশান্তি তথা পারিবারিক কলহ, বিচ্ছেদ ও বাবা মায়ের দূরত্ব।
যেমন ; একজন বাবা যদি অন্য কোনো নারীর সাথে সম্পর্ক করে আর মা সারাক্ষণ সেই স্বামীর চিন্তায় থাকে, এতে পারবে কি কোনো নারী সন্তানের খেয়াল বা যতœ নিতে? পারবে না। মন ভাল না থাকলে পৃথিবীর কোনো কাজ সুষ্ঠু ভাবে করা সম্ভব নয়। অসংখ্য পরিবারে দেখা যায় স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকে তাদের মাঝে যোগাযোগ নেই, নেই কোনো সু সম্পর্ক।
এতে বেশির ভাগ শিশু ঝড়ে পড়ে বাবা মায়ের উদাসীন উদ্ভট হেয়ালিপনা, অবহেলায়। এতে সন্তান আগাছার মতো বেড়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বিভিন্ন নেশা সেবনে লুটপাট ছিনতাইয়ে।
৪। বর্তমান বিনোদন গুলো যা আমরা উপভোগ করি এতে কি কোনো সন্তান তথা শিক্ষার্থীর সুফল বয়ে নিয়ে আসে? ভাল কিছু শিখতে পারে? তা হয় না। হিংসের বীজ বপন হয় প্রত্যেকের অন্তরে। মেধা বিকাশের জায়গায় কুটকৌশল, ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রীক মন মানসিকতার দানা বাঁধে।
বাবা মায়ের গা ঘেষে যে হারে স্টার জলসা, জি বাংলা, কালারস বাংলার সিরিয়াল দেখছে, এতে কি শিখছে আপনার সন্তান ? ভেবে দেখুন আপনারাই ! সন্তানের আচরণে বলে দিচ্ছে তারা মানব হয়ে উঠছে না দানব?
৫। গোপন তথ্য প্রকাশে বিশেষ সুযোগ -:
সন্তান যদি জানতে পারে, তার মা বা বাবার গোপন কিছু তথ্য সেই সুযোগ নিয়ে তারা বাবা মাকে ব্ল্যাকমেইল করে, অবাধে চলাফেরা করে, বাধা দিতে গেলেই বলে আমি কিন্তু বলে দেবো---উদাহরণ স্বরূপ-:
মা ছেলেকে বলছে, তুমি হুজুরের কাছে দোয়া তাবিজ করেছ অনেক টাকা দিয়ে, আর বাবা এ কথা জানলে তোমায় প্রাণে রাখবেনা। ব্যাস এই হুমকিই যথেষ্ট অবাধে চলার।
কিংবা মা কারো সাথে দেখা করলো বা কোথাও কোনো কাজে গেল, কিংবা গোপনে টাকা লেনদেনের ব্যবসা করা।
এমন ছোটো খাটো নানা কারণ যা গোপন রাখা হয় অনেকের কাছে। সন্তানের চোখে বাবা মাকে হতে হবে শ্রেষ্ঠ মানুষ, যার মাঝে কোনো ভেজাল নেই! সন্দেহ নেই ! বাবা মায়ের দূর্বলতা সন্তান জানবে কেন? এই জানাটাই ওরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পরম সুযোগে। শাসন সোহাগ সমপরিমাণ না হলে কোনো সন্তানের সফলতা প্রত্যাশা করা যায়না।
এখন অধিকাংশ বাবা মা রেডিমেড প্রেমিক- প্রেমিকাকে যে হারে ম্যাসেঞ্জারে বা বাইরে সময় দেয়। এতে কি করে সম্ভব শিশুর সুন্দর স্বপ্নিল জীবন প্রস্ফুটন হওয়ার? প্রশ্নেই আসেনা। অর্থ উপার্জন করা বড় কথা না সেই অর্থ যথাযথ কাজে লাগা ও পরিবারে সময় দেয়া এটাই প্রধান কাজ প্রত্যেক বাবা মায়ের।
প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন না হলে পরিবারের প্রতি খেয়াল না রাখলে পৃথিবীর কোনো আইন বা শাসন ব্যবস্থা- ধর্ষণ, খুন, নামে এই মহামারিকে রোধ করতে পারবেনা। প্রত্যেক বাবা মা সন্তানকে সময় দিক, তাদের কাছে ভাল মানুষ হয়ে উঠার চেষ্টা করুক - তবেই- ভয়, শ্রদ্ধা, সম্মান সৃষ্টি হবে সন্তানের হৃদয়ে। আর আপনার সন্তানও হয়ে উঠবে মানুষের মতো মানুষ ।
আবারো বলছি, প্রত্যকেই নিজ সন্তানকে সময় দিন, বিবেকবোধ জ্বালিয়ে সুন্দর স্বপ্নের বীজ বপন করুন সন্তানের অন্তর প্রান্তরে। তারা আবিষ্কার করুক নিজেকে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হিসেবে সৃষ্টি বিজয়ের সংগীতে