পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ,রাষ্ট্রদূত সামিনার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়, ক্ষমতার উৎস কী?
ররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। ১২ জুলাই সময় সংবাদের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ভিয়েতনামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের কথা উঠে আসে। এরপরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরো কয়েক কর্মকর্তার সামিনা নাজের হাতে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা বেরিয়ে আসে।
অনুসন্ধানে সরকারের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা ও তার কোটাভূক্ত আরও কয়েক কর্মকর্তার দুর্নীতির ছবিও উঠে এসেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ এক সময় ভারতের মুম্বাইতে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তখন (২০১৫ সাল) এক নারী কর্মকর্তা মিশনে যোগ দিতে সেখানে যান। কিন্তু সামিনা নাজ ও তার পৃষ্ঠপোষকতাকারী একটি পক্ষের অঙ্গুলী-হেলনে তাকে মিশন কক্ষে আটকে রেখে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হয়।
নির্যাতনের শিকার হয়ে ওই নারীকে গুরুতর অবস্থায় মুম্বাই হাসপাতালের আইসিইউতে ৫ দিন ভর্তি থাকতে হয় বলে জানায় সূত্রটি। পরে অসুস্থ অবস্থাতেই নিজের চেষ্টায় দেশে ফিরে আসেন তিনি।
জানা যায়, এই নির্যাতনের ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য সামিনা নাজের সহযোগী একটি পক্ষ ওই নারী কর্মকর্তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এজন্য তারা নকল মেডিকেল সার্টিফিকেটও প্রস্তুত করে। ওই নারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও রুজু করা হয়। হেনস্থা করার জন্য অধস্তন কর্মচারীদের সাক্ষী হিসেবে এনে তার বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করানো হয়।
পরে নির্যাতিতার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। নিরপেক্ষ মেডিকেল বোর্ড তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ বলে প্রতিবেদন প্রদান করে।
তবুও থেমে থাকেনি সামিনা নাজ গং। শেষ পর্যন্ত ওই নারী কর্মকর্তাকে চাকুরী থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে সেই সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন করতে না পারলেও এখনো ওই নারী কর্মকর্তার পোস্টিং ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
পরবর্তীতে মুম্বাইতে ওই নির্যাতিতা নারী কর্মকর্তার পদে তারিক হাসান নামের আরেক কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। সে সময় মুম্বাইতে থাকা রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ তার ওপরও বিভিন্ন নির্যাতন শুরু করেন।
মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তারিক হাসানকে দৈনিক ভাতা প্রদান করতেন না সামিনা নাজ। শিশু সন্তানের চিকিৎসার বিল দিতেন না। তারিক হাসানের বাসার ইলেক্ট্রিসিটির লাইন পর্যন্ত কেটে দেন তিনি।
রকারি নিয়ম অনুযায়ী বিদেশে কর্মরত মিশনের কর্মকর্তাদের বাসায় যে ন্যূনতম আসবাবপত্র ক্রয়ের টাকা দেয়ার কথা তারিক হাসানকে সেটিও দেয়া হয়নি। তিনি বার বার সামিনা নাজের কাছে সেই টাকা অনুমোদনের অনুরোধ জানালেও কোনো উত্তর দেননি তিনি।
পরে ফার্নিচারের টাকা সময়মতো পরিশোধ না হওয়ায় মুম্বাইতে ওই কর্মকর্তার বাসাও ঘেরাও করেন ফার্নিচার বিক্রেতা। এ ধরনের ঘটনা বিদেশের মাটিতে দেশের সম্মান নষ্ট করেছে বলে জানায় সূত্রটি।
নানা অভিযোগ থাকলেও সামিনা নাজের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সামিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় তারিক হাসানকে ইথিওপিয়াতে বদলী করে দেয়া হয়।
সামিনা নাজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তথ্য ক্যাডারের নবম ব্যাচের এক কর্মকর্তা পোস্টিং-এর মাঝপথে দেশে চলে আসেন বলেও জানা যায়।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভাইবারে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে সামিনা নাজ সম্পর্কে আরো একটি তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নজরে আসে। অজ্ঞাত সূত্র থেকে আসা সেইসব ভাইবার মেসেজে দাবি করা হয়, মুম্বাইতে থাকাকালীন চেন্সারী ভাড়া করার নামে এজেন্টের সাথে যোগসাজসে সামিনা নাজ প্রায় ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার পকেটস্থ করেছেন। এজেন্টকে তিনি পরবর্তীতে ৫ হাজার ডলার দিয়ে ম্যানেজ করেন। এ ঘটনায় তাকে সহায়তা করেন পরিচালক (এফএসও) রাশেদ।
তবে মন্ত্রণালয়ে সামিনা নাজ দাবী করেছেন, চেন্সারী ভাড়া করার জন্য এজেন্ট নিয়োগ করে তাকে একবছরের অগ্রিম ও একমাসের নিরাপত্তা জামানতসহ প্রায় ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার ক্যাশ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে সেই এজেন্টকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। টাকা নিয়ে সে পালিয়ে যায়।
সামিনা নাজের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ সত্ত্বেও তার কোন তদন্ত হয় না। বরং ১৫ বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের মেধা তালিকায় সবচেয়ে জুনিয়র হয়েও ১৩ জনকে ডিঙ্গিয়ে তাকে ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত করা হয়। সেখানেও রাষ্ট্রদূত হিসেবে সামিনা নাজ চরম অযোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি সরকারি দল সফরে যাবার কথা তাকে জানানোর পরও ছুটি নিয়ে সম্প্রতি দেশে চলে এসেছেন। ওই সরকারি দলটি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার মতো কোনো দায়িত্ব কর্মকর্তা সেখানে না থাকা সত্ত্বেও সামিনার ছুটি নেয়া নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, কে তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে? দূতাবাস সূত্র থেকে জানা যায় যে, কিছুদিন আগে ভিয়েতনাম সফরে গিয়ে এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা রীতি অনুযায়ী কোন হোটেলে না থেকে রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজের বাসায় থেকেছেন। যদিও সরকার থেকে তাঁকে হোটেলে থাকার খরচ প্রদান করা হয়েছে।
এর আগে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা সরকারী সফরে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের বাসায় রাত্রিযাপন করেছেন বলে জানা যায় না।
উর্ধ্বতন ওই সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিজের কোটা তৈরি করে কোটাভূক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া এবং বিভিন্ন অভিযোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখার অভিযোগও রয়েছে।
ওই কোটাভূক্ত আরেক কর্মকর্তা হলেন শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ। রিয়াজের হয়রানির শিকার হয়েছেন তদানীন্তন প্রথম সচিব জনাব মো. সাকিব সাদাকাত এবং কাউন্সেলর মালেকা পারভীন। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করায় দীর্ঘ দিন পদোন্নতি বন্ধ থাকে মো. সাকিব সাদাকাতের। রিয়াজ হামিদুল্লাহর প্রভাব-প্রতিপত্তির ভয়ে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি মালেকা পারভীন। তার নির্যাতনে মনির নামে একজন পিও পর্যায়ের কর্মচারী পালিয়ে চলে এসে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করে। কিন্তু নির্যাতনের প্রতিকার না করে তার বিরুদ্ধেই বিভাগীয় মামলা শুরু করে মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে কর্মচারী ও জুনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তারা রিয়াজ হামিদুল্লাহর সাথে কাজ করতে রাজী না হওয়ায় মন্ত্রণালয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে শ্রীলঙ্কা এবং ভিয়েতনামের মিশনগুলোর মতো জায়গায় মন্ত্রণালয় থেকে কর্মচারী প্রেরণ না করে স্থানীয়ভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগ করা হবে। এর প্রতিবাদে মন্ত্রণালয়ের সকল স্তরের কর্মচারীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছেন।
এদিকে, জার্মানি থেকে গাড়ি কেনার একটি ঘটনায় করাচীতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নূরে হেলাল সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে ৩৫ লক্ষ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। তিনিও ওই বিশেষ কোটাভূক্ত কর্মকর্তা। ফলে তাকে বাঁচানোর জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জার্মানিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী সরকারকেও এই অভিযোগের সাথে জড়ানো হয়। ৩৫ লক্ষ টাকার মধ্যে ১৮ লক্ষ টাকার দায়ভার চাপিয়ে দেয়া হয় তার ওপর।
collected news