গাইবান্ধায় বন্যায় ৬০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, নষ্ট ১৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল
গাইবান্ধায় বন্যায় ৬০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, নষ্ট ১৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল ভুক্তভোগীরা দিশেহারা গাইবান্ধা জেলার সাত উপজেলায় চলমান বন্যায় ৫৯ হাজার ৮৭০টি পরিবারের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় ।
পানিতে ডুবে পচে নষ্ট হয়েছে ১৪ হাজার ২১ হেক্টর জমির আউশ ধান, আমন বীজতলা, পাট ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসলাদি । মরে-ভেসে গেছে প্রায় ৬ হাজার ২৯০টি পুকুর-খামারের চাষকৃত মাছ । বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৫৯৩ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক, ২৬৬ কিলোমিটার পাকা সড়ক ও ১৯ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ। ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত ছোট-বড় ৩১টি ব্রীজ-কালভার্ট।
গতবছরের ক্ষতিগ্রস্ত বীজ কালভাট গুলো এখনো পুরাপুরি সংস্কার করা না হলেও এবারের বন্যায় সেগুলো সহ নতুন নতুন করে ব্রিজ কালভাট গুলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকয়েক দিনের চলমান বন্যায় জেলার গ্রামীন কাচা রাস্তা গুলো বেহাল অবস্থা দাড়িয়েছে। সে গুলো চলাচলে অযোগ্য হয়ে পড়ায় ব্যাপক দূর্ভোগ পোহাচ্ছে বানভাসী মানুষেরা।
গত ১২ দিন ধরে পানিতে তলিয়ে আছে গাইবান্ধার সাত উপজেলার চরাঞ্চল-নিম্নঞ্চলের ৪ শতাধিক গ্রামের বির্স্তীণ জনপদ। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩৯৭ জন। দুর্গত এলাকার অধিকাংশ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়ন প্রকল্প, উচু জায়গা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও স্কুল-প্রতিষ্ঠিনের বিভিন আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। কাজকর্মহীন দরিদ্র এসব মানুষের মধ্যে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির অভাব ও পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
কয়েকদিন ধরে পানিবন্দি থাকায় তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। পাশাপাশি গবাদি পশুর খাদ্যের সংকট নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছেন দূর্গতরা। এদিকে, খোলা আকাশ আর রোদের মধ্যেই আশ্রয় নেয়া মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে দুদিনের থেমে থেমে চলা বৃষ্টির কারণে। বৃষ্টির কারণে একদিকে যেমন নেমে যাওয়া পানি ধীরে ধীরে আবার বাড়ছে তেমনী ত্রিপল, কাপড় আর ছাপড়া ঘর তুলে আশ্রয় নেয়া মানুষের দুর্ভোগ-ভোগান্তি বাড়ছে। গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি নিয়ে কোন রকমে গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। তবে প্রশাসন ও বিভন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিতরণ করা ত্রাণ সামগ্রী চাহিদার তুলায় অনেক অপ্রতুল বলে অভিযোগ বানভাসীদদের। দূর্গম চরাঞ্চলসহ, বাঁধ, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
পায়খানা, প্রসাবখানার অভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া অনেকের মধ্যে পানিবাহিতসহ দেখা দিয়েছে নানা রোগ-বালাই। কিন্তু অনেক এলাকায় ঔষধসহ চিকিৎসা সেবা মিলছে না বলেও বানভাসীদের অভিযোগ। বন্যা পরিস্থিতির কারণে জেলার সাত উপজেলায় ৪৪৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১০৫টি। গত এক সপ্তাহে পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে শিশুসহ ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এরমধ্যে শুধু গোবিন্দগঞ্জ উপজেলাতেই পানিতে ডুবে শিশুসহ মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। সড়ক ও বাঁধের অন্তত ২০টি পয়েন্ট ভেঙে এবং ধ্বসে যাওয়ায় গাইবান্ধা জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সুন্দগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার। বাদিয়াখালি-ত্রীমোহনি রেল লাইনে পানির প্রবল স্রোতে ভেঙে গেছে ১ কিলোমিটার এলাকার স্লিপার, ধ্বসে গেছে পাথর। এতে এক সপ্তাহ ধরে গাইবান্ধা-বোনারপাড়া থেকে রেল যোগাযোগ চলছে বিকল্প পথে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বুধবার (২৪ জুলাই) বিকেল পর্যন্ত দূর্গত এলাকায় ১০৭০ মেট্রিকটন চাল, ৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, নগদ সাড়ে ১৯ লাখ টাকা ও বিশুদ্ধ পানির জন্য ১৫০টি টিউবয়েল ও ৫ হাজার বিশুদ্ধ পানির জ্যারকিন এবং ৫০০টি ত্রিপল বিতরণ করা হয়েছে।
জরুরী স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে ১৮০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে দূর্গত এলাকায়। বন্যায় ১৯৭টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন জানান, দূর্গত মানুষের জন্য মজুদ প্রায় ৮০ মেট্রিক টন চাল, ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও ২০০ ত্রিপল বিতরণের প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া দূর্গত এলাকার মানুষের জন্য আরও ১ হাজার মেট্রিক টন চাল, ১০ লাখ টাকা ও ৫ হাজার শুকনা খাবার প্যাকেট বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। তবে বানভাসীদের ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'সাত উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নঞ্চলের পানিবন্দি মানুষের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অব্যহত রয়েছে। তবে লোকবল আর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় কিছু এলাকায় দূর্গতদের মাঝে ত্রাণ পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে। প্রতিটি দিন-রাত বানভাসীদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ যথেষ্ট আন্তরিকভাবে কাজ করছে সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা'।
জেলা প্রশাসক স্বাক্ষরিত বন্যা পরিস্থিতির সর্বশেষ তৈরী প্রতিবেদন (২৩ জুলাই) অনুযায়ী দেখা যায়, বন্যায় দুটি পৌরসভা ও সাত উপজেলার ৫১টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল-নিম্নঞ্চলের ৪২৪টি গ্রামের বির্স্তীণ জনপদ তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩৯৭ জন মানুষ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে দেখানো হয় ৫৯ হাজার ৮৭০টি পরিবার। এসব পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত টিউবয়েলের সংখ্যা ১০ হাজার ৫৯টি। ৬ হাজার ২৯০টি পুকুর ও জলাশয়ের বিপুল পরিমাণ মাছ ভেসে-মরে গেছে। দুর্গত এলাকার ১৪ হাজার ২১ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ১৯ কিলোমিটার, পাকা সড়ক ৫৯৩ কিলোমিটার, ২৬৬ কিলোমিটার পাকা সড়ক ও ৩১টি ব্রীজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপরদিকে, গত ২০ জুলাই শনিবার থেকে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে থাকে।
কিন্তু গত মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) থেকে আবারও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে গাইবান্ধাতে। এতে করে তিস্তা, ব্রক্ষ্মপুত্র, ঘাঘট নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ফলে আতষ্কিত হয়ে পড়েছেন দূর্গত এলাকার মানুষরা। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, ব্রক্ষ্মপুত্রের পানি কমে বিপদসীমার ৩২ সে. মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও আজ ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তা বেড়ে ৪৯ সে. মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ঘাঘট নদীর পানি ১২ সে. মি থেকে বেড়ে শহর পয়েন্টে বিপদসীমার ২৬ সে. মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বৃষ্টিপাত অব্যহত ও উজানের ঢলে আবারও নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ার আশষ্কা রয়েছে। জেলার বানবাসীদের ত্রান সহায়তাসহ বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকা গুলোতে চিকিৎসা সেবা আরো জোড়দার করা দরকার।