আসামের তালিকাবঞ্চিতরা বাংলাদেশি নয়, ‘নব্য রোহিঙ্গা’!
ভারতের আসামে আজ সকালে প্রকাশিত হয়েছে নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা। এই তালিকায় আসামে বসবাসকারী ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ ভারতের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পাননি। এদের অনেকেই বাংলাভাষী। অভিযোগ রয়েছে তাঁরা বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে শরণার্থী হয়ে ভারতে বসবাস করছিলেন।
আসামের এনআরসি তালিকাবঞ্চিতরা বাংলাদেশি না। তাদের বাংলাদেশে ফেরাতে হলে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে প্রমাণ করতে হবে ভারতের। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও গত ২০ আগস্ট ঢাকায় বলেছেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও বিষয়টিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ভারতের নাগরিক হতে না পারা এ বিপুলসংখ্যক মানুষ ‘দেশহীন’ তকমা পেতে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অনেকেই এ পরিস্থিতিকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তুলনা করে আসামের নাগরিকপঞ্জির তালিকা বঞ্চিতদের ‘নব্য রোহিঙ্গা’ হিসেবে তুলে ধরছেন।
সর্বশেষ হিসাবে আসামের এনআরসি তালিকায় নাম নেই ১৯,০৬,৬৫৭ জনের। ভারতে বসবাস করলেও ভারতীয় নয়, এমন মানুষদের নিয়েই জটিলতা তৈরি হয়েছে। এতদিন ভারতে থেকেছেন তাঁরা।
প্রায় দুটি প্রজন্মের এই ‘আপাত দেশহীনদের’ কোনোভাবেই বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করবে না। তা আগেই জানিয়ে দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। নয়াদিল্লির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ঢাকা আগেই জানিয়ে দিয়েছে এই কথা।
এনআরসি তালিকায় নাম না ওঠা ১৯ লক্ষের বেশি আসামবাসীকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সূত্রে ‘বাংলাদেশি’ তকমা জুড়ে দেওয়া হলেও এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশে তাদের স্থান নেই। এ কারণেই বাংলাদেশে বসবাসকারী ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এনআরসি তালিকাভুক্ত না হওয়া আসামবাসীর তুলনা করছেন অনেকেই।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। মিয়ানমার সরকারের কঠিন অবস্থানের কারণে তারা নিজ দেশে ফিরতে চান না। বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়ায় তারাও ‘দেশহীন নাগরিক’ তকমা পাচ্ছেন।
নতুন এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর আসাম সরকার জানিয়েছে, এ তালিকায় যাদের নাম বাদ পড়ল তারা নতুন করে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন। ভারত সরকার পূর্ণ সহযোগিতা করবে তাদের। তবে শেষ পর্যন্ত কতজন নিজেদের ফের ভারতীয় প্রমাণ করতে পারবেন তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
বাংলাদেশ সংলগ্ন আসামের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হলো হাইলাকান্দি, কাছাড় ও করিমগঞ্জ। বরাক নদ তীরবর্তী এই এলাকায় বাংলাভাষীরা সংখ্যাগুরু। প্রাথমিক হিসেব বলছে, এসব অঞ্চলের লক্ষাধিক বাংলাভাষী মুসলমানদের নাম ওঠেনি এনআরসিতে। শুধু তাই নয়, এ তালিকা থেকে বাদ গেছে বহু হিন্দুর নামও।
আসামে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি সরকার। তবে বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, বাংলাভাষী মুসলমানদের দেশহীন করে ভোটের বাইরে রাখার ছক করা হয়েছে এনআরসিতে। এদিকে বহু হিন্দুর নাম বাদ পড়ায় রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব ক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন।
আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসির প্রথম তালিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে, ভারত ভাগের চার বছর পর। সে সময় তত্কালীন পূর্ববঙ্গ যা পূর্ব পাকিস্তানের থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসামে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এরপর পরিস্থিতি জটিল হয় ১৯৭১ সালে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় ২৫ মার্চ রাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ পালিয়ে চলে যায় ভারতে। আসাম, পশ্চিমবাংলা, মেঘালয়, ত্রিপুরায় তারা ঠাঁই নেন। পরে বাংলাদেশ তৈরি হলেও এই শরণার্থীদের অনেকেই আর ফিরে যাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে আসামে বাংলাভাষী বিরোধী মনোভাব দেখা যায় ১৯৭৯ সাল থেকে। আসামের রাজনৈতিক সংগঠন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন(আসু) এই বাংলাভাষীদের নিয়ে প্রবল বিক্ষোভ দেখতে শুরু করে সে সময় থেকে।
এছাড়া বিভিন্ন আসামিয়া সংগঠনগুলো দাবি তোলে, বাংলাদেশিদের চাপে আসামের নিজস্ব সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাবে। ‘নেলি গণহত্যা’র মতো রক্তাক্ত আন্দোলনের পর ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার ‘আসাম অ্যাকর্ড’ চুক্তি করে।
সেই চুক্তি অনুসারে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে যারা ভারতে চলে এসেছেন তাদের ক্ষেত্রে নমনীয় মনোভাব নেওয়া হয়। সেই সূত্র ধরেই জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকায় যাদের নাম উঠল না তারা নিজেদের ‘বিদেশি’ ভাবতেও নারাজ। আবার ভারতেও তারা আপাত ‘দেশহীন’।
ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা আসামে নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হবে তারা বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী। তবে আসামের বিপুলসংখ্যক বাসিন্দার ‘রাষ্ট্রহীন’ হওয়ার ঝুঁকিসহ নানা শঙ্কার মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর গত ২০ আগস্ট ঢাকায় স্পষ্ট বলেছেন, এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
ভারতের অভ্যন্তরীণ সূত্রেই এখন প্রশ্ন উঠছে, তারা কি আসামে থাকা বিরাট শরণার্থী গোষ্ঠীতে পরিণত হতে চলেছেন? আশঙ্কা করা হচ্ছে এই রেশ ধরে জাতিগত সংঘাত তৈরি হতে পারে আসামে।
তবে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল জানিয়েছেন এখনই চিন্তার কারণ নেই। সংঘাত এড়াতে আসামে জারি করা হয়েছে কড়া নিরাপত্তা। সূত্র : কলকাতা