তুরস্ক সুযোগ পেলে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে
গত বছরের সেপ্টেম্বরে তুরস্কের সিভাস শহরে ক্ষমতাসীন একে পার্টির এক সমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তুরস্কের পরমাণু অস্ত্র তৈরির বাসনা নিয়ে ওই বক্তব্যে বিশ্বকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। তবে তুরস্ক আসলেই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে কিনা তা পরিষ্কার করেনি।
এরদোয়ান বলেছিলেন, ‘বেশ কয়েকটি দেশের পারমাণবিক ওয়ারহেডসহ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। কিন্তু আমাদের সেটা নেই। আমি এটা মানতে পারছি না। বিশ্বে এমন কোনো উন্নত দেশ নেই, যারা এই অস্ত্রের মালিক না।’ এরদোয়ানের এই বক্তব্যের পর গোটা বিশ্ব পরিষ্কার যে, তুরস্ক সুযোগ পেলে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে।
এরদোয়ান পরমাণু অস্ত্রের বাসনা প্রকাশ করলেও দেশটি এই অস্ত্র তৈরি না করতে চুক্তিবদ্ধ। ১৯৮০ সালে পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তিতে সই করে তুরস্ক। ১৯৯৬ সালে বিস্তৃত পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধ চুক্তিতেও সই করে দেশটি। চুক্তিতে যে কোনো উদ্দেশে পরমাণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে তুরস্ক সেটি করতে পারবে না।
তুরস্ককে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে হলে পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সেটি করলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের যে ধরণের প্রতিক্রিয়ার মুখে দেশটি পড়বে তা মোকাবেলার সক্ষমতা এরদোয়ানের নেই। যার প্রমাণ ২০১৮ সালে দেখা গেছে।
২০১৬ সালে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান চেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুরস্কে গ্রেফতার হয়েছিলেন মার্কিন ধর্ম যাজক এন্ড্রু ব্রানসন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানালেও কর্ণপাত করেননি এরদোয়ান। বিচার শেষে ২০১৮ সালে এন্ড্রু ব্রানসনকে সাজা দেয়া হয়। ফলে কঠোর অবস্থানে যায় যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্কের ইস্পাতসহ কয়েকটি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশে শুল্ক বাড়ানো হয়। তাতেই ধরাশায়ী হয়ে যায় আঙ্কারা। শেষ পর্যন্ত এন্ড্রু ব্রানসনকে মুক্তি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।
মূলত ২০০২ সালে একে পার্টি ক্ষমতায় আসা ও ২০১৪ সালে এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে তুরস্ক উচ্চ বাসনার বাহনে উড়তে শুরু করে। এরদোয়ানের নানা বক্তব্য, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নীতি, বিরোধী মত দমনসহ নানা বিষয় বিশ্লেষণ করলে এর বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। এরদোয়ানের মস্তিষ্ক যে, তুর্কিদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে কাজ করছে তা অনেকটা পরিষ্কার।
তুর্কিরা অটোমান সামাজ্যের উত্তরসূরি। ঐতিহাসিকভাবে তুর্কি সাম্রাজ্য বা অটোমান সম্রাজ্য ছিল একটি ইসলামি সাম্রাজ্য। প্রথম উসমানের পিতা আরতুগ্রুল গাজী । প্রথম উসমান ১২৯৯ সালে সেলযুক সাম্রাজ্য কর্তৃক উত্তরপশ্চিম আনাতোলিয়ার দায়িত্ব পান। তিনি সেলযুক সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থাকলেও সাম্রাজ্যের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ধীরে ধীরে একটি বৃহৎ সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে প্রথম মুরাদ কর্তৃক বলকান জয়ের মাধ্যমে উসমানীয় সাম্রাজ্য বহু মহাদেশীয় সাম্রাজ্য হয়ে উঠে এবং খিলাফতের দাবিদার হয়। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের কনস্টান্টিনোপল জয় করার মাধ্যমে উসমানীয়রা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য উচ্ছেদ করে। ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরি জয়ের পর ইউরোপের বলকান অঞ্চল সমূহ নিয়ে বড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৬শ’ ও ১৭শ শতাব্দীতে বিশেষত সুলতান প্রথম সুলাইমানের সময় উসমানীয় সাম্রাজ্য দক্ষিণপূর্ব ইউরোপ, উত্তরে রাশিয়া কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস, উত্তর আফ্রিকা ও হর্ন অব আফ্রিকা জুড়ে , মধ্যপ্রাচ্য ও আরব অঞ্চলসহবিস্তৃত একটি শক্তিশালী বহুজাতিক, বহুভাষিক সাম্রাজ্য ছিল। ১৭শ শতাব্দীর শুরুতে সাম্রাজ্যে ৩৬টি প্রদেশ ও বেশ কয়েকটি অনুগত রাজ্য ছিল। এসবের কিছু পরে সাম্রাজ্যের সাথে একীভূত করে নেয়া হয় এবং বাকিগুলোকে কিছুমাত্রায় স্বায়ত্ত্বশাসন দেয়া হয়।
উসমানীয় সাম্রাজ্য সুদীর্ঘ ছয়শত বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে দীর্ঘদিনব্যাপী ইউরোপীয়দের তুলনায় সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। ধারাবাহিক অবনতির ফলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর আনাতোলিয়ায় নতুন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আধুনিক তুরস্কের উদ্ভব হয়। বলকান ও মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যের সাবেক অংশগুলো প্রায় ৪৯টি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
তুরস্কের বর্তমান শাসক এরদোয়ান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম শাসকদের মতো নয়। তার দল একে পার্টি প্রকাশ্যে ইসলামি দল না হলেও তাদের মূল চরিত্র বা চালিকা শক্তি ইসলামি রাজনীতি। এরদোয়ান ছাত্রজীবন থেকেই এই রাজনীতির অংশ। সুতারাং সৌদি আরব, কাতার ও আমিরাতের শাসকদের মতো ভোগ-বিলাস বা সম্পদের প্রাচুর্যে বিভোর থাকার চেয়ে বরং তার কাছে অতীত ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ।
এরদোয়ান ঠিক সেই পথেই হাঁটছেন। নিজেদের সর্বোচ্চ মেধা কাজে লাগিয়ে সামরিক শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে। পরমাণু অস্ত্রের মালিক হওয়ার বাসনা এর একটি অংশ। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় নানাভাবে প্রভাব বিস্তারে জোর চেষ্টা করছেন এরদোয়ান।
বর্তমান দুনিয়ার বাস্তবতায় নতুন কোনো অটোমান সাম্রাজ্য গড়া অসম্ভব হলেও হয়তো নতুন সুলতান হওয়া সম্ভভ। এরদোয়ান তুরস্ককে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে নিয়ে নিজেকে সুলতানের আসনে বসাতে পারেন। ৩৮ কোটি ৪০ লাখ পাউন্ড খরচ করে ‘হোয়াইট প্যালেস’ নামে ১ হাজার রুম বিশিষ্ট নতুন প্রেসিডন্সিয়াল প্যালেস নির্মাণ তাঁর সুলতান হওয়ার বাসনার ফল। মুসলিম বিশ্বে এখন আর কোনো শাসক নেই যিনি এমন প্রাসাদ থেকে রাজ্য পরিচালনা করছেন।
তবে এরদোয়ানের বাসনা পূর্ণ হওয়ার সবচেয়ে বড় বাধা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বপরিস্থিতি বদলে যায়। দুনিয়ার কর্তা হয়ে ওঠে পাঁচ মোড়ল বা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স। ফলে বিশ্বের বড় বড় সব সিদ্ধান্ত নেন এই দেশগুলো। এখানে তুরস্কের কোনো ভুমিকা রাখার সুযোগ নেই।
ফলে এখানেও পরিবর্তন চান এরদোয়ান। গত বছর জাতিসংঘে আফ্রিকান বিজনেস ফোরামে সেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ইজ গ্রেটার দ্যান ফাইভ’। এর আগেও তুরস্ক প্রায় এক দশক ধরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পুনর্গঠনের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করছে।
তুরস্ক বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তারে এসবের বাইরেও নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ন্যাটোর সদস্য হয়েও তারা রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে। রাশিয়া থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ ভারী অস্ত্রও কিনছে। সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে গ্যাস লাইনের চুক্তির ফলে এখন রাশিয়া ও ইউরোপের কাছে তুরস্কের কদর বেড়েছে। ফলে ইউরোপের সঙ্গে তুরস্কের দর কষাকষির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
স্থানীয়ভাবে এরদোয়ান নিজ দেশের সীমানার বাইরে সিরিয়ার একটি বিরাট অঞ্চল দখলে রেখেছেন। সিরিয়া ছাড়াও লিবিয়া ও কাতারে তুর্কি সেনা রয়েছে। গ্রিসের প্রভাব কমাতে লিবিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে তুরস্ক। খনিজ সম্পদ আহরণের নামে তুরস্ক সাইপ্রাসেও উপস্থিতি নিশ্চিতের চেষ্টা করছে।
আফ্রিকায় ইতিমধ্যে নিজেদের বেশ প্রভাবশালী জায়গায় নিয়ে গিয়েছে তুরস্ক। ২০০৮ সালে তুর্কি-আফ্রিকা সহযোগিতা সম্মেলন হয়। এতে আফ্রিকার প্রায় ৫০টি দেশ অংশ নেয়। গত বছর আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের বাণিজ্য বেড়েছে ১২ শতাংশ। আফ্রিকায় ২০০৩ সালে তুরস্কের বিনিয়োগ ছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালের পর এরদোয়ান আফ্রিকার প্রায় ৩০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। এরদোয়ান যুদ্ধাবিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষগ্রস্ত সোমালিয়া ভ্রমণ করেন ২০১১ সালে। সেখানে সহায়তার নামে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন এরদোয়ান।
এদিকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে বসতে তুরস্কের ভুমিকা চোখে পড়ার মতো। বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিষয়গুলো নিয়ে সরব এরদোয়ান। রোহিঙ্গা সঙ্কট, কাশ্মীর সঙ্কট এবং উইঘুরদের পক্ষে বলিষ্ট কণ্ঠ তাকে মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলেছে। সম্প্রতি মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় মুসলিম দেশগুলোর সম্মেলন করেছেন। এসবের মাধ্যমে তিনি মুসলিম বিশ্বে সৌদির প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছেন। ব্যক্তি এরদোয়ান ইতিমধ্যে মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছেন।
তবে এরদোয়ানের ‘হোয়াইট প্যালেস’কে ‘অটোম্যান প্যালেস’ বা মুসলিম বিশ্বের প্রথম ‘পরমাণু প্যালেস’ বানানোর পরিকল্পনা সহসাই বাস্তবায়ন হবার নয়। ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের কথা বাদ দিলেও খোদ মধ্যপ্রাচ্যেই প্রবল বাধার মুখে তিনি। মুসলিম বিশ্বে সৌদি আর তার বিকল্প কোনো শক্তির উত্থানকে মানবে না। ইসরাইল প্রভাবিত বলয়; সৌদি, মিশর, কুয়েত বা আমিরাতের মতো দেশগুলোর সমর্থন পাবেন না। ফলে এরদোয়ানের পরমাণু অস্ত্রের স্বপ্ন বা নব্য সুলতান হওয়ার বাসনা কতটা বাস্তবায়ন হবে তা আগামীর ইতিহাসেই দেখা যাবে।