বাংলাদেশ-মালদ্বীপ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন দিগন্ত
মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরের বুকে প্রায় এক হাজার ২০০ দ্বীপ নিয়ে মালার মতো ছড়িয়ে থাকা একটি দ্বীপরাষ্ট্র। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, নীলাভ-সবুজ জলরাশি, সাদা বালুকাময় সমুদ্রসৈকত ও উন্নত মানের পর্যটনের কারণে মালদ্বীপ সারা বিশ্বের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের তিন বছর পর ১৯৬৮ সাল থেকে মালদ্বীপ প্রজাতন্ত্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে।
এই দেশের জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ ৩০ হাজার এবং অভিবাসীর সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজারের মতো। বিচ্ছিন্ন দ্বীপরাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও মালদ্বীপ গত ২০ বছরে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছে। ১০ বছর ধরে ৬ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে এবং মাথাপিছু আয় ১১ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে এরই মধ্যে মালদ্বীপ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। মালদ্বীপের শিক্ষার হার প্রায় ১০০ শতাংশ অর্জন, জনগণের গড় আয়ু ৭৮ বছরে উন্নীতকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাস্থ্যসেবাসহ সরকারি বিভিন্ন সেবা জনগণের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর থেকে দুই দেশ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবিক সংকটে বাংলাদেশ সর্বদা মালদ্বীপের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সুনামি-পরবর্তী সময় মালেতে খাওয়ার পানি সংকটে বাংলাদেশ দ্রুত মানবিক সহায়তাসহ মালদ্বীপের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
এই ক্ষুদ্র দেশে প্রায় এক লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছে, যা দেশটিতে কর্মরত মোট প্রবাসী কর্মীর ৭০ শতাংশ। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখানে নির্মাণ, পর্যটন, বিপণন, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য খাতসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাজ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপে বেশ কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি আনডকুমেন্টেড হয়ে পড়েছেন। তাঁদের অনেকে ২০১৯ সালে মালদ্বীপ সরকারের গৃহীত নিয়মিতকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করছেন।
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় অন্য সব দেশের মতো মালদ্বীপও আক্রান্ত হয়েছে। সেখানে মালদ্বীপে এ পর্যন্ত ১৬ হাজারের বেশি লোক কারোনায় আক্রান্ত হয়েছে; যার মধ্যে ৫৪ জন মারা গেছে। পর্যটননির্ভর এ দেশে এই মহামারিতে ২০২০ সালে পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতিতে বিরূপ অবস্থা দেখা দেয়। বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্প থেমে যাওয়া এবং রিসোর্ট, হোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক লোক চাকরি হারান।
এ ক্ষেত্রে আনডকুমেন্টেড প্রবাসী বাংলাদেশিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং কষ্টে দিনাতিপাত করেন। মালদ্বীপ সরকার, এনজিও ও হাইকমিশনের পক্ষ থেকে প্রবাসী দুস্থ বাংলাদেশিদের যথাসম্ভব মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়। এ ছাড়া মালদ্বীপ সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের জন্য বিনা মূল্যে করোনা পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিনসহ চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হয়। মালদ্বীপ সরকার প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীসহ মালদ্বীপে বসবাসরত সবাইকে বিনা মূল্যে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে। ২০২০ সালে মালদ্বীপ সরকারের অর্থায়নে স্বেচ্ছায় দেশে ফেরা কর্মসূচির আওতায় ১০ হাজারের বেশি আনডকুমেন্টেড প্রবাসী বাংলাদেশি কোনো খরচ ছাড়াই স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে যান।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ প্রয়োজনীয় জরুরি ওষুধ, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা সামগ্রী, পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও প্রয়োজনীয় জরুরি খাদ্যসামগ্রী নৌবাহিনীর জাহাজ সমুদ্র অভিযানের মাধ্যমে মালদ্বীপে পাঠানো হয়। এ ছাড়া একই সময়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কার্গো বিমানে করে বাংলাদেশ ও নেপালে আটকে পড়া মালদ্বীপের নাগরিকদের নিরাপদে দেশে পৌঁছে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি মেডিক্যাল টিম দুই মাসের বেশি সময় মালদ্বীপে অবস্থান করে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সহযোগিতা করে।
মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মানবসম্পদ রপ্তানি, বেসামরিক বিমান চলাচল ও তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশক্রমে বর্তমান সরকার ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ মালদ্বীপের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র নিরূপণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। উভয় দেশ মানবসম্পদ উন্নয়নে সহযোগিতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়েছে।
এই পটভূমিতে ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক। আশা করা যায়, এই সফরে বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে মানবসম্পদ প্রেরণ এবং বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণবিষয়ক সহযোগিতার বিষয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। এ ছাড়া মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন ও গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকার, জয়েন্ট কমিশন অন টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন, দ্বৈতকর প্রত্যাহার, বন্দিবিনিময় চুক্তিসহ আরো কিছু সমঝোতা স্মারক চূড়ান্তকরণসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করা হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুুল হামিদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহকে বাংলাদেশ ভ্রমণে আমন্ত্রণ জানালে তিনি ওই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। আশা করা যায়, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরকালে দুই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আরো নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।
সাম্প্রতিককালে ঢাকায় আয়োজিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ-২০২০’ মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্স, গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডাপ্টেশন, ক্লাইমেট ভালনারেবিলিটি ফোরামের বিভিন্ন আয়োজনে মালদ্বীপের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রগতির ইঙ্গিত বহন করে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান স্পিকার মোহাম্মদ নাসিদকে ক্লাইমেট ভালনারেবিলিটি ফোরামের ‘থিমেটিক অ্যাম্বাসাডর ফর অ্যাম্বিশন’ হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন।
এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবিসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতি মালদ্বীপের সমর্থন প্রশংসনীয় ও আশাব্যঞ্জক। উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে উভয় দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে আশা করা যায়।
লেখক : মালদ্বীপে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত