খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা নিতে বলেছিলেন
জাতীয় সংসদ থেকে বিরোধীদলগুলোর একযোগে পদত্যাগ এবং রাজপথে তুমুল আন্দোলন উপেক্ষা করেই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফাভাবে নির্বাচন করে বিএনপি। দেশের সব মহলে এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর রাজপথের আন্দোলন তীব্রতর হয়। চরম অবনতি ঘটে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির। বিরোধীদলগুলোর আন্দোলন ব্যর্থ করতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় সেনা মোতায়েতের চেষ্টা করেও কাজ হয়নি।
১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর উদ্ভুত সংকটকালীন পরিস্থিতিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান জানান বলে ওই ঘটনাবলির ওপর রচিত বইপত্রে পাওয়া যায়। তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বললেও বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার দেওয়া বক্তব্যে এর আভাস পাওয়া যায়।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জেনারেল নাসিম ‘চাকুরীতে পুনর্বহাল’ সংক্রান্ত যে আবেদন করেন সেখানে তিনি বলেন: ‘ক্ষমতা ত্যাগের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী (খালেদা জিয়া) আমাকে সরাসরি অনুরোধ করেন নির্বাচনে তাহার দলকে বিজয়ী হতে সাহায্য করিবার জন্য।’
তবে জেনারেল নাসিমকে ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বানের কথাকে গুজব মন্তব্য করে খালেদা জিয়া এ কথা সরাসরি নাকচ করেছিলেন বলে দাবি করেন মেজর জেনারেল এমএ মতিন। তিনি ২০ মে, ’৯৬ এর কথিত অভ্যুত্থান চেষ্টার সময় সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং অনুগত হিসেবে পরিচিত সাবেক এ সেনাকর্মকর্তা ওয়ান ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন।
১৯৯৭ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সাপ্তাহিক চলতিপত্রে লেখক-সাংবাদিক আনোয়ার কবিরের ’২০ মে, ’৯৬ সেনাবাহিনীতে কী ঘটেছিল’ শীর্ষক নিবন্ধের প্রতিবাদলিপির একটি পর্যায়ে জেনারেল মতিন লিখেছেন: ’৯৬-এর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি ডিজি জিজিএফআই হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর একদিন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে (খালেদা জিয়া) সেনানিবাসের অভ্যন্তরে বিরাজমান একটি গুজবের (সেনাপ্রধান নাসিমকে ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান) কথা জানিয়ে তার সত্যতা সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি একে অবাস্তব এবং নাসিম গংদের ছড়ানো গুজব বলে মন্তব্য করেন।
সেসময় খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিক এবং শাণিত প্রতিক্রিয়া দেখান বলেও উল্লেখ করেন জেনারেল মতিন।
১৯৯৬ সালের মে মাসে যে দু’জনকে কেন্দ্র করে ঘটনার শুরু তাদের একজন বগুড়ার তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খান সরাসরি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। চ্যানেল আই অনলাইনের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জেনারেল নাসিম কখনও এ বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেননি।
তবে ওই ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সাবেক সেনাকর্মতারা এবং এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা কেউ কেউ মনে করেন, জেনারেল মতিনের ও্ই বক্তব্যের মাধ্যমে সেনাপ্রধান নাসিমকে খালেদা জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান নিয়ে সেনাসদরে যে সত্যিই আলোচনা ছিল তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তা না হলে তিনি (জেনারেল মতিন) কেনইবা খালেদা জিয়াকে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে যাবেন!
বিশ্লেকষদের ধারণা, ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ব্যর্থ হওয়া, গণআন্দোলন তীব্রতর হওয়া এবং বিএনপি সম্পর্কে জনগণের নেতিবাচক ধারণা স্পষ্ট হওয়ার ফলে বিএনপি অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হলে তারা আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাই যেকোন মূল্যে নির্বাচনে জয়লাভ করতে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে চায়।
আবার জেনারেল নাসিম যেহেতু সরকারের চাওয়ামতো সবকিছু করছিলেন না তাই তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়। জেনারেল নাসিম তার বইয়ে নিজেই এ দাবি করেছেন।
তবে ওই চেষ্টা যেহেতু সফল হয়নি তাই সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বিএনপি অনুগতদেরকেই রেখে যাওয়ার চেষ্টা চলে। এর অংশ হিসেবেই নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মতিনকে ডিজিএফআই’র মহাপরিচালক করা হয়, আর ডিজিএফআই’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামানকে করা হয় নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি।
পাশাপাশি নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যকে সফল করতে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে গঠিত সংসদে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ হয় তাতে নজিরবিহীনভাবে রাষ্ট্রপতির হাতে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিএনপি মনোনীত আব্দুর রহমান বিশ্বাস।
ওই সময়ের কথা কথা উল্রেখ করে সাবেক সেনা কর্মকর্তারা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন, আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়ার আগে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সংবিধানে যে সংশোধনী আনে তাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। মূলতঃ জেনারেল নাসিম তাদের হয়ে কাজ করবেন না এমন নিশ্চিত ধারণা থেকেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে নেওয়া হয়। শুরুতে বিষয়টি কেউ খেয়াল করেনি।
সেনাবাহিনীতে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবেই সেনাপ্রধানকে উপক্ষো করে ১৮ মে, ১৯৯৬ মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খান এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিরন হামিদুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস। এ ঘটনায় বিধিভঙ্গ হয়েছে দাবি করে সেনা সদর বাধ্যতামূলক অবসরের আদেশ বাতিলের অনুরোধ জানায়। রাষ্ট্রপতি সেটা না শোনায় সেনা সদর এবং বঙ্গভবনের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয় যা চলে ২১ মে জেনারেল নাসিম আটক হওয়া পর্যন্ত।
রাষ্টপতি বিশ্বাস নিজের অনুগত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিজের পক্ষে নিয়ে ২১ মে সেনাপ্রধান নাসিমসহ ৭ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আটক করলে নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান। তিনি এখন বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য।