কে, কারা, কেন? জবাব নেই
মাইক্রোবাসে তুলে চোখ বেঁধে ঢাকা থেকে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারকে। কে, কারা, কেন তাঁকে তুলে নিল? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজছে সবাই। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ ওঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেই।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিন্টো রোডে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, ফরহাদ মজহার জানিয়েছেন, গত সোমবার ভোরে ওষুধ কেনার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হলে কয়েকজন লোক একটি মাইক্রোবাসে করে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, পুলিশ এখন জানার চেষ্টা করছে, কারা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
আবদুল বাতেন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ফরহাদ মজহার তাঁদের জানিয়েছেন, মাইক্রোবাসে থাকা অবস্থায় তিনি নিজের মোবাইল ফোন থেকে স্ত্রীকে ফোন করে বলেন যে ৩৫ লাখ টাকা দিলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
ফরহাদ মজহারের পারিবারিক সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময়ে ৩৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকার কথা বলা হয়। তখন ফরহাদ মজহারের পরিবার থেকে বলা হয়, তাঁরা টাকা জোগাড় করছেন। তবে পরিবার ধারণা করছিল, মুক্তিপণ নেওয়া মূল উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁদের বিভ্রান্ত করার জন্য টাকা চাওয়া হয়েছিল।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ফরহাদ মজহার গত সোমবার ভোর পাঁচটার দিকে রাজধানীর আদাবরে তাঁর বাসভবন থেকে বের হন। এরপর শ্যামলী মোড়ের কাছে এলে তিন ব্যক্তি তাঁকে জোর করে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তোলে। এরপর তাঁর চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসের মেঝেতে বসায়। এরপর দুই পাশের দুজন তাঁকে মাথা নিচু করে থাকতে বাধ্য করে। একপর্যায়ে তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা মুঠোফোন দিয়ে স্ত্রীকে ফোন করে বলেন, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ এ কথা বলতে না–বলতেই অপহরণকারীরা তাঁর ফোন কেড়ে নেয়। অপহরণকারীরা তাঁকে মাইক্রোবাসের মেঝেতে বসিয়ে রাখে এবং ভয় দেখায়।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সোমবার ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার পর প্রযুক্তির সহায়তায় মোট ছয়বার তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। প্রথমে তাঁর অবস্থান ছিল গাবতলী, পরে মানিকগঞ্জ, দৌলতদিয়া ঘাট, ফরিদপুর, যশোর এবং সর্বশেষ অবস্থান ছিল খুলনা। বেলা তিনটার পর সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ এলে সবাই তৎপর হয়। ওই সময় সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়।
ফরহাদ মজহারের স্বজনেরা আশঙ্কা করছিলেন, তাঁকে সীমান্তের ওপারে নেওয়া হতে পারে।
উদ্ধারের পর ঢাকায়
ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের পর র্যাব বলেছে, সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের অভয়নগর এলাকায় খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর প্রথমে ফরহাদ মজহারকে খুলনায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে সেখান থেকে গতকাল সকাল পৌনে নয়টার দিকে তাঁকে ঢাকার আদাবর থানায় আনা হয়।
থানায় ফরহাদ মজহারের স্ত্রী, মেয়ে ও স্বজনেরা আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন। স্বজনদের কাছে পেয়ে ফরহাদ মজহার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এ সময় স্ত্রী ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখা যায় তাঁকে। থানায় নাশতা করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা শেষে সকাল সাড়ে ১০টার পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাঁকে দুই ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
গোয়েন্দা কার্যালয়ের ফটকে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার, মেয়ে সম্তলী হক, পারিবারিক বন্ধু গৌতম দাসসহ কয়েকজনকে একটি মাইক্রোবাসে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সেখানে ফরিদা আখতার বলেন, ‘সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর চোখ বাঁধা ছিল। তাঁকে ব্লাড প্রেশারের ওষুধ দিয়েছি আর সামান্য কিছু খাবার দিয়েছি।’
মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয় থেকে বেলা আড়াইটার দিকে ফরহাদ মজহারকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আদাবর থানায় হওয়া একটি মামলার ‘ভিকটিম’ হিসেবে ফরহাদ মজহারকে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য আদালতে পাঠানো হয়।
পুলিশ বলেছে, আদাবর থানায় ফরহাদ মজহারের পরিবারের করা অপহরণের অভিযোগটি মামলা হিসেবে নেওয়া হয়েছে। আদালতে জবানবন্দি রেকর্ডের পর তার ভিত্তিতেই তদন্ত চলবে।
খুলনা প্রতিনিধি জানান, সোমবার রাত আটটার দিকে খুলনা নগরের নিউমার্কেটের উত্তর পাশে অবস্থিত গ্রিল হাউস নামের একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খান ফরহাদ মজহার। এ সময় তাঁর পরনে ছিল সাদা লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি আর মাথায় ছিল একটি সাদা রুমাল, সেটা এলোমেলোভাবে প্যাঁচানো। তবে ওই সময় তাঁর কাছে কোনো ব্যাগ ছিল না বলে নিশ্চিত করেছেন ওই রেস্তোরাঁর মালিক আবদুল মান্নান।
জানতে চাইলে রেস্তোরাঁর মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত আটটার দিকে যখন তিনি রেস্তোরাঁয় ঢোকেন, তখন তাঁকে খুব ক্লান্ত লাগছিল। তিনি এক কোনার একটি টেবিলে বসেন। এরপর খাবারের তালিকা (মেন্যু) চান। তালিকাটি নিয়ে তিনি বেশ কিছুক্ষণ দেখে ভাত, ডাল ও সবজি দিতে বলেন। এ সময় তাঁকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। খাবার তৈরি হতে হতে তিনি ফ্রেশ হয়ে এসে কিছুক্ষণ টেবিলের ওপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েন। ওয়েটারের ডাকে তাঁর ঘুম ভাঙে।’ রেস্তোরাঁর মালিক আরও বলেন, ‘চামচ দিয়েই খাওয়াদাওয়া করেন তিনি।’ তবে তিনি একা ছিলেন, নাকি আশপাশে কেউ ছিল, তা তিনি বলতে পারেননি।
যশোর প্রতিনিধি জানান, ফরহাদ মজহারকে বহনকারী হানিফ পরিবহনের বাসটি ঢাকার উদ্দেশে খুলনা থেকে ছেড়ে আসে সোমবার রাত ৯টা ১৫ মিনিটে। যশোর-খুলনা মহাসড়ক দিয়ে অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় বাসটি পৌঁছায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে।
নওয়াপাড়া বাজার অতিক্রম করে বেঙ্গল টেক্সটাইল মিলসের সামনে এলে বাসটি থামানো হয়। অভয়নগর থানার পুলিশ বাসটির সুপারভাইজার হাফিজুর রহমানকে ফোন করে গাড়িটি থামাতে বলেন। রাত ১১টায় পুলিশ পৌঁছে বাসে তল্লাশি শুরু করে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ ফরহাদ মজহারকে বাস থেকে নামিয়ে আনে। এ সময় র্যাব-৬-এর একটি দল তাঁকে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে তাদের গাড়িতে তোলে। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাবের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে র্যাব তাঁকে নিয়ে উল্টোপথে খুলনার দিকে যেতে থাকে। পুলিশের গাড়িটি তখন র্যাবের গাড়ির পিছু নেয়। তখন প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে খুলনার ফুলতলায় ডিআইজির নির্দেশে পুলিশের আরও গাড়ি র্যাবের গাড়িগুলোকে ব্যারিকেড দেয়।
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফরহাদ মজহারকে বাস থেকে নামানোমাত্র র্যাবের একটি দল তাঁকে তাদের কাছে হস্তান্তর করতে বলে। কিন্তু আমরা তাতে রাজি না হওয়ায় তাদের সঙ্গে বিতণ্ডা হয়।’
বাসটির সুপারভাইজার হাফিজুর রহমান জানান, ফরহাদ মজহার কোচের আই-৩ আসনের যাত্রী ছিলেন। তিনি খুলনার শিববাড়ি কাউন্টার থেকে বাসে ওঠেন। নওয়াপাড়ার কাছাকাছি স্থান থেকে তিনি টিকিট চেক করেন। তাঁর টিকিটে নাম লেখা ছিল মিস্টার গফুর।
অন্য একটি সূত্র জানায়, ওই বাসে ফরহাদ মজহারসহ মাত্র তিনজন যাত্রী ছিলেন। বাকি দুজন গোয়েন্দা সংস্থার লোক কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করার পর সোমবার দিবাগত রাত ১টা ২০ মিনিটে খুলনার ফুলতলা থানায় সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ জানিয়েছিলেন, তাঁর ব্যাগে মোবাইল ফোনের চার্জার, শার্টসহ বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনের আগেই পুলিশ ফরহাদ মজহারকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
আদালতে জবানবন্দি
গতকাল বিকেল ৫টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন ফরহাদ মজহার। ঢাকার মহানগর হাকিম আহসান হাবীব তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করে ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় তাঁকে নিজ জিম্মায় বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেন। বিকেল ৫টা ৫২ মিনিটে একটি মাইক্রোবাসে করে আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন ফরহাদ মজহার। এ সময় সাংবাদিকেরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি রাজি হননি। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বারডেম হাসপাতালে যান। এখন সেখানেই চিকিৎসাধীন তিনি।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেন, যারা বর্তমান সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায়, তারা তাঁকে অপহরণ করেছে। তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, যারা অপহরণ করেছে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চিনতেও পারে। কারণ, গত সোমবার একজন পুলিশ কর্মকর্তা ফরহাদ মজহারের বাসায় বসে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে অবস্থান জানছিলেন। কিন্তু অপহরণকারীদের গতিবিধি অনুসরণ করার পরও পুলিশ তাদের ধরার চেষ্টা করেনি।
ফরহাদ মজহারকে অপহরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর স্ত্রী ফরিদা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামীকে ফিরে পেয়েছি। এতেই খুশি।’ মেয়ে সম্তলী হক বলেন, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত।