রাতভর হত্যার প্রস্তুতি চললেও ঘুমিয়ে ছিল সেনা সদর
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়। ভয়াবহ সেই দিনটির কথা উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষীদের জবানবন্দিতে। জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায় সেদিনের ভয়াবহতার চিত্র। জানা যায় ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন ৩২ নম্বরের বাড়িটির ভেতরে-বাইরে। সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে চ্যানেল আই অনলাইনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের সপ্তম পর্ব।
প্রসিকিউশনের ১১নং সাক্ষী এল. ডি. বশির আদালতকে জানান, তিনি ঘটনার সময় ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের হেড কোয়ার্টার স্কোয়াড্রনে ল্যান্স দফাদার ছিলেন। মেজর এ. কে. এম. মুহিউদ্দিন তাদের স্কোয়াড্রন কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে অনুষ্ঠিত নাইট ট্রেনিংয়ে তার ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর ফারুকসহ মেজর এ. কে. এম. মুহিউদ্দিন, মেজর শরফুল হোসেন, মেজর নুরুল হক, লেঃ কিসমত, লেঃ নাজমুল হোসেন, রিসালদার সারোয়ার, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, এল. ডি. আবুল হাশেম মৃধা, দফাদার মারফত আলীসহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। মেজর মুহিউদ্দিনের অফিস এবং তার ব্যারাকের রুম সামনা-সামনি ছিল। রাত প্রায় ১২টার দিকে বাইরে এসে মেজর মহিউদ্দিনের অফিস থেকে সাদা পোশাকধারী ২জন লোককে বাইরে যেতে দেখেন। মেজর মুহিউদ্দিন বাইরে এসে একজনকে লক্ষ্য করে বলেন, হুদা এদিকে এসো। তখন হুদা তার সঙ্গী লোককে ‘ডালিম দাঁড়াও’ বলে মেজর মুহিউদ্দিনের কাছে গেলে মেজর মুহিউদ্দিন বলেন, তোমাদের ইউনিফরমের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
রাত ৩.৩০টায় আবার ট্রেনিং শুরু হলে তিনি কোর থেকে হাতিয়ার ও গুলি নেন। অন্যরাও হাতিয়ার নিতে আসে। কোরে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র-গুলি ছিল। এখানে সৈনিকদের কয়েকটি দলে ভাগ করে মেজর মুহিউদ্দিন বলেন, একটু পরে কনভয় মুভ করবে। তখন ট্যাংক বের হওয়ার শব্দ শোনেন। তারপর মেজর মুহিউদ্দিনের নির্দেশে রিসালদার সারোয়ারসহ একটি গাড়িতে উঠেন। আর্মি ইউনিফরম পরিহিত একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন তাদের গাড়ির সামনের সিটে বসেন। তাদেরকে মেজর মুহিউদ্দিনের অফিসে সাদা পোশাকে দেখেছিলেন। রিসালদার সারোয়ার তাদেরকে মেজর নুর ও ক্যাপ্টেন হুদা বলে পরিচয় দেয়।
রাত প্রায় ৪টার সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২নং রোডে ৬৭৭ নং বাড়ির প্রায় ৮০ গজ পশ্চিমে রাস্তার উপর একজন নায়েক ও তাকে নামিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল করতে না দেওয়া ও পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করার ডিউটি দেয়। এর প্রায় ৪/৫ মিনিট পরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গুলির আওয়াজ এবং হ্যান্ডস-আপ শব্দ শোনেন। ঐ সময় আর্টিলারি সেলের ৩/৪টা আওয়াজ শোনেন। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হলে রিসালদার সারোয়ার তাকে ডেকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটে ডিউটি দেয়।
তখন মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নুর, ক্যাপ্টেন হুদা, রিসালদার সারোয়ার ও আর্টিলারি সুবেদার মেজরকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেখেন। একটু পরেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতরে গুলির শব্দ এবং পুরুষ মহিলাদের আর্ত-চিৎকার শোনেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নুর, ক্যাপ্টেন হুদা রিসালদার সারোয়ার ও আর্টিলারির সুবেদার মেজর বাইরে আসে। তখন পশ্চিম দিক থেকে একটি ট্যাংকে মেজর ফারুককে আসতে দেখে স্যালুট করেন। মেজর ফারুক ট্যাংক থেকে নেমে মেজর মুহিউদ্দিন, মেজর নুর, ক্যাপ্টেন হুদা, রিসালদার সারোয়ার, আর্টিলারির সুবেদার মেজরসহ আরো কয়েকজন আর্টিলারির লোকের সঙ্গে কথা বলে ট্যাংকে উঠে চলে যান।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতরে কয়েকজন সিভিলিয়ানকে লাইন আপ অবস্থায় দেখেন এল. ডি. বশির। আদালতকে তিনি বলেন, তখন তাদের রেজিমেন্টের লেঃ কিসমত, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী, এল. ডি. আবুল হাশেম মৃধাকে সেখানে দেখেন। কিছুক্ষণ পর পূর্বদিক থেকে কয়েকজন সৈনিক লাল রংয়ের একটি কার বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতরে পশ্চিম পাশে নিয়ে রাখেন। সেই কারের ভিতরে একটি লাশ দেখেন। পরে জানতে পারেন সেটা কর্নেল জামিলের লাশ ছিল। এক সময় মেজর আজিজ পাশাকেও বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটে দেখেন। রিসালদার সারোয়ারের কাছ থেকে মেজর আজিজ পাশার পরিচয় জানতে পারেন। তিনি ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারে আসার পর এল. ডি. আবুল হাশেম মৃধাকে চিনেন। দফাদার মারফত আলীকে আগে থেকেই চিনতেন। এল. ডি. সিরাজও তাদের হেড কোয়ার্টার স্কোয়াড্রনে ছিল।
১২নং সাক্ষী এল. ডি. সিরাজ
প্রসিকিউশনের ১২নং সাক্ষী এল. ডি. সিরাজ বলেন, ঘটনার সময় ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের হেড-স্কোয়াড্রনে ছিলেন তিনি। ১৪ই আগস্ট রাতে নাইট ট্রেনিংয়ে তাদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর ফারুক ও মেজর মুহিউদ্দিন, মেজর শামসুজ্জামান, ক্যাপ্টেন দেলোয়ার, লেঃ কিসমত, লেঃ নাজমুল হোসেন, রিসালদার সৈয়দ আহম্মদ, রিসালদার আনোয়ার, রিসালদার কুদ্দুস, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, রিসালদার মোবারক, আর. ডি. এম. মোসাদ্দেকসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। রাত ৩.৩০টার সময় মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন হুদা ও আরেকজন অফিসারকে তাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। মেজর ফারুক তাদেরকে ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আগামীকাল ১৫ই আগস্ট ইউনিভার্সিটিতে মিটিং হবে। সেই মিটিংয়ে রাজতন্ত্র ঘোষণা করা হবে, শেখ মুজিব রাজতন্ত্র ঘোষণা করবেন। আমরা রাজতন্ত্র সমর্থন করি না, এখন আমি যা বলব এবং আমার অফিসাররা যা বলবে তা তোমরা শুনবে’। এরপর তার নির্দেশে কোর থেকে এমিউনিসন নিয়ে মেজর মুহিউদ্দিনের নির্দেশে গাড়িতে উঠে তাদের ইউনিটের ভেতরে খাকি ইউনিফরম পরা ২ ট্রাক ভর্তি আর্টিলারি রেজিমেন্টের সৈনিক দেখেন। ওরাও তাদের সাথে যাবে।
রাত প্রায় ৪.৩০টার সময় বালুরঘাট থেকে তাদের ইউনিটের ৪টি ও আর্টিলারির ২টি মোট ৬টি গাড়ি একসঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নং রোডের মুখে গেলে ট্রাকের সামনের সিটে থাকা মেজর মুহিউদ্দিন নামিয়ে তাদের কয়েকজনকে মিরপুর রোডে ডিউটি দেয়। বাকিদের নিয়ে ৩২নং রোডের ভিতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই গুলির আওয়াজ শোনেন তিনি। সকাল প্রায় ৭টার সময় আর্টিলারি কামানের ৩/৪টি সেলের আওয়াজও শোনেন। সকাল প্রায় ৭টার সময় কাছে একটি দোকানের রেডিওতে শোনেন ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ সোয়া ৭টার সময় ৩২নং রোড থেকে একটি ট্যাংক মিরপুর রোড হয়ে দক্ষিণ দিকে যায়। ঐ ট্যাংকে মেজর ফারুককে দেখেন। কিছুদূর যাবার পর মেজর ফারুক ট্যাংক থেকে নেমে সেখানে ডিউটিরত সৈনিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে একটি জীপে উঠে দক্ষিণ দিকে চলে যায়, তিনি হলেন ১১ নং সাক্ষী এল. ডি. বশির ও হেড কোয়ার্টার স্কোয়াড্রনে ছিলেন।
১৩নং সাক্ষী দফাদার শফিউদ্দিন
প্রসিকিউশনের ১৩নং সাক্ষী দফাদার শফিউদ্দিন আদালতকে বলেন, তিনি ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারে জীপের গাড়ি চালক ছিলেন। ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে বালুর ঘাট এলাকায় তাদের নাইট ট্রেনিং হয়। গভীর রাতে ২ ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ তাদের ইউনিটে গিয়ে মেজর ফারুকসহ বের হয়ে যান। পরে মেজর ফারুক ইউনিটে ফেরত আসেন। রাত প্রায় ৩.৩০ টার সময় রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী, এ.এল.ডি. আবুল হাশেম মৃধা একটি ট্রাকে উঠে তাকে অনুসরণ করতে বলেন। তিনি অনুসরণ করে মহাখালী পৌঁছালে তার গাড়িতে একজন অফিসার ও আর্টিলারির ২/৩ জন সৈনিক উঠে। রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের ট্রাকে কিছু সৈনিক উঠে। তারপর ধানমন্ডি লেকের দক্ষিণ পাড়ে গিয়ে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী, এ.এল.ডি. আবুল হাশেম মৃধা ও অন্যান্যরা রাস্তার ডানে দোতলা একটি বাড়িতে উঠে। একটু পরেই ঐ বাড়িতে গুলির আওয়াজ শোনেন। পরে বাইরে এসে ধানমন্ডি ৩২নং রোডের মাথায় মিরপুর রোডে গাড়ি থামান। সেখানে দফাদার মারফত আলী কাছ থেকে জানেন যে, শেখ মনি ও তার স্ত্রীকে গুলি করে ঐ বাড়িতে হত্যা করেছে। তখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গোলাগুলির আওয়াজ শোনেন এবং আলী ও এল. ডি. আবুল হাশেম মৃধা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যায়। কিছুক্ষণ পর মেজর ফারুক একটি ট্যাংকে ৩২নং রোড থেকে বের হয়ে মিরপুর রোডে উঠে তাদেরকে রেডিও স্টেশনে চলে যেতে বলেন। এ ট্যাংকে লেঃ কিসমতকেও দেখেন। তারা রেডিও স্টেশনে গিয়ে খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, মেজর রশিদ, মেজর শরিফুল হোসেন, লেঃ নাজমুল হোসেন ও আরো অফিসারকে রেডিও সেন্টারের ভিতরে যেতে দেখেন।
প্রসিকিউশনের ১৪নং সাক্ষী দফাদার জব্বার মৃধা
প্রসিকিউশনের ১৪নং সাক্ষী দফাদার জব্বার মৃধা আদালতকে বলেন, ঘটনার সময় ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার ছিলেন। ১৪ই আগস্ট রাতে নাইট ট্রেনিংয়ে মেজর ফারুক, মেজর এ.কে.এম. মহিউদ্দিন, মেজর শরফুল হোসেন, লেঃ কিসমত, লেঃ নাজমুল হোসেনকে দেখে। সেখানে সিভিল পোশাকে কয়েকজন অফিসার এবং ২ ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ ঐ ইউনিটের আরো কয়েকজন অফিসারও ছিলেন। তাদের সাথে একই মাঠে আর্টিলারির সৈনিকও ছিল। মেজর ফারুক ঐ সিভিল পোশাকধারী, মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার আরো কয়েকজনকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করবেন। উনারা যা নির্দেশ দেন সেই মতো কাজ করতে হবে। এই বলে বালুর ঘাট থেকে ট্যাংক মুভ করার নির্দেশ দেন। ট্যাংকের গোলা ছিল না।
তারা ট্যাংকের কমান্ডার ছিলেন। মেজর শরিফুল হোসেন, মেজর ফারুক নিজেও একটি ট্যাংকের কমান্ডার ছিলেন। অপর একটি ট্যাংকে কমান্ডার লেঃ কিসমত এবং আরেকটি ট্যাংকের কমান্ডার লেঃ নাজমুল হোসেন ছিলেন। তাদের ট্যাংক সরাসরি রেডিও সেন্টারে যায়। লেঃ নাজমুল হোসেনের ট্যাংক পুরাতন রেইস কোর্সের মোড়ে যায়। ভোর প্রায় ৫.৩০টার সময় মেজর ডালিম একটি খোলা জীপে করে রেডিও সেন্টারে এসে মেজর শরিফুল হোসেনের সঙ্গে আলাপ করতে করতে ভেতরে যায়। ৫/৭ মিনিট পর মেজর শাহরিয়ারও ভেতরে যায়। পরে আর্মি ও সিভিল গাড়িতে আরো আর্মি ও সিভিলিয়ান রেডিও সেন্টারে যাতায়াত করে।
তখন শুনি রেডিওতে প্রচার হচ্ছে ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’। সকাল সাড়ে আটটা/পৌনে ৯টার সময় সেনাপ্রধান রেডিও সেন্টারে আসেন। তার পিছনে মেজর ডালিম ছিলেন। ১৭ই আগস্ট ২টা পর্যন্ত রেডিও সেন্টারের ডিউটি করে লাইনে চলে যান।
১৫নং সাক্ষী কমান্ডার গোলাম রব্বানী
প্রসিকিউশনের ১৫নং সাক্ষী কমান্ডার গোলাম রব্বানী আদালতকে জানান, সাক্ষী দেওয়ার সময় তিনি ডাইরেক্টর ডিজিএফআই হিসাবে কাজ করছিলেন। ঘটনার সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর একজন এডিসি ছিলেন। আর্মির ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ এবং এয়ার ফোর্সের ফ্লাইটে লেঃ মোশারফ হোসেনও তখন রাষ্ট্রপতির এডিসি ছিলেন। তারা বঙ্গভবনে থাকতেন। কিন্তু ডিউটি করার জন্য গণভবন ৩২নং রোডের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যেতেন। ১৫ আগস্ট সকাল ৬টার সময় তার সহকারি ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ তার রুমে এসে বলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গোলাগুলি হচ্ছে। রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিঃ মাশরুরুল হক তাদেরকে তাড়াতাড়ি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারা ৩ জন নিজ নিজ পোশাকে বঙ্গভবনের গাড়িতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে রওনা দেয়। পথে সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এবং ধানমন্ডি ৬নং রোডের মাথায় কালো ও খাকি পোশাক পরিহিত কিছু সৈনিক দেখে। প্রথমে তারা বাধা দেয়, পরে পরিচয় দিলে যেতে দেয়।
সামনের দিকে এগিয়ে ৩২নং রোডের মাথায় আরো কিছু সৈনিক দেখেন। সেখানের সৈনিকরা তাদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। পরিচয় দিলে সুবেদার উত্তেজিত হয়ে তাদের চশমা, ঘড়ি, মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। সেখানে অফিসার না থাকায় কথা বলতে পারেন নাই। তারপর তাদের ৩ জনকে রশি দিয়ে হাত বেঁধে লেকের ধারে একটি নার্সারিতে বসিয়ে রাখে। সেখানে একটি ঘর থেকে ট্রানজিস্টারের আওয়াজে শুনে ‘আমি মেজর ডালিম বলছি- স্বৈরাচার মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’
গোলাম রব্বানী আদালতকে জানান, কিছুক্ষণ পর ঐ সৈনিকরা তাদের চোখ বেঁধে দেয়। তখন তারা গান লোডের শব্দও শোনেন। প্রায় ২/৩ ঘণ্টা পর একজন অফিসারের নির্দেশে তাদের বাঁধন খুলে দেয়। বাঁধন খোলার পর দেখেন সেই অফিসার ছিলেন মেজর ফারুক। তাদেরকে গণভবনে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি আরেক অফিসারকে নির্দেশ দেন। পরে জানতে পারেন এ অফিসার সেকেন্ড লেঃ। পরে মেজর শহিদুল্লাহর মধ্যস্থতায় তাদের বাঁধন খুলে গণভবনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে এটাও জানতে পারে যে, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন তাদেরকে শেষ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মেজর শহিদুল্লাহ তাদেরকে এসকর্ট করে গণভবনে নিয়ে এডিসির রুমে কড়া পাহারার মধ্যে রাখে। কিছুক্ষণ পর ব্রিঃ মাশরুরুল হক আর্মি হেড কোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করলে তাদেরকে আর্মি হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করার জন্য বলা হয়। তারা বঙ্গভবনের একটি গাড়িতে করে আর্মি হেড কোয়ার্টারে মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল নাসিমের কাছে রিপোর্ট করে।
সেখানে অনেকক্ষণ থাকার পর আর্মি হাই কমান্ডের নির্দেশ অনুযায়ী তারা ৪টার সময় বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে খন্দকার মোস্তাককে বসে থাকতে দেখেন। সেখানে তখন কিছু সিভিলিয়ানসহ আর্মি ইউনিফরমে উচ্চ ও নিম্নপদস্থ আর্মি অফিসার দেখেন। মেজর ফারুক, মেজর রশিদ, মেজর সুলতান শাহরিয়ার, মেজর ডালিম, মেজর নুর, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মেজর হুদা, ক্যাপ্টেন মাজেদ, রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের কথাবার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। এদের কথাবার্তায় আরো জানতে পারেন যে, তারা শেখ মনি ও তার স্ত্রীকে এবং সেরনিয়াবাত ও তার বাড়ির অন্যান্যকে হত্যা করেছে। বঙ্গভবনে থাকাকালীন এই সব হত্যাকারী অফিসাররা প্রায়ই বঙ্গভবনে যাতায়াত করতো এবং কেউ বঙ্গভবনে থাকত। তারপর ৩রা নভেম্বর কিছু সংখ্যক হত্যাকারী অফিসার বিদেশে চলে যায়।