হাসপাতাল নয়, বিয়ে বাড়ি
সকাল থেকে রাজধানীর জাতীয় নিউরোসাইন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কেমন যেন সাজসাজ রব। দুই তলায় চিকিৎসকরা অপেক্ষা করছেন ৪৭ জন অতিথির জন্য। যারা সর্বনাশা বিরল ভাইরাস জিবিএসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কেউ ইতিমধ্যে সুস্থ জীবনে ফিরেছেন। কেউ ফেরার লড়াই করছেন। ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ, আরও সহজতর করতে, হাসপাতালটির এমন আয়োজন। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখা সুমি চোখের জল মুছতে, মুছতে বললেন, ‘এখানের ডাক্তাররা মানুষ নন, ফেরেশতা। তিন মাস আইসিইউতে ছিলাম। আজ মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ি এসেছি।’
সুমিকে দেখে ডাক্তার উজ্জ্বল চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই সুমি এসেছে, সুমি এসেছে।’ ঘাড় ফেরানোর আগে দেখলেন চন্দ্রা নামের আরেকজনকে। দুজনের কাছেই দৌড়ে গেলেন। তিনজনের আলাপ দেখে মনে হল দুই বোনকে নিয়ে খুনসুটিতে মেতে আছেন এক মধ্যবয়সী লোক!
এই সুমি আর চন্দ্রা এখনও হাঁটতে পারেন না! হুইল চেয়ারে করে হাসপাতালে এসেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৪৭ জন রোগীর ভেতর ছয়জন এখনও হাঁটতে পারেন না। বাকিরা হেঁটেই ডাক্তার-রোগীর মিলনমেলায় উপস্থিত হয়েছেন।
জিবিএস একটি নার্ভের রোগ। খুব বিপজ্জনক। চিকিৎসা ব্যয়বহুল। একটি পরিবারকে নি:স্ব করতে এই রোগের জুড়ি মেলা ভার। আক্রান্ত ব্যক্তির দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে জ্বর, কাশি কিংবা ডায়রিয়া হতে পারে। কয়েকদিনের ভেতর চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন তাকে আইসিইউতে ভর্তি না করালে নির্ঘাত মৃত্যু। দেশে এমনও ইতিহাস আছে মাসের পর মাস কাউকে আইসিইউ নামক ওই নীরব কক্ষে কাটিয়ে দিতে হয়েছে। অধিকাংশ রোগীকে দুই থেকে তিন মাস আইসিইউতে থাকতে হয়। বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে একদিন রাখলে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা গুনতে হয়! নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে সেখানে সম্পূর্ণ বিনা খরচে এইসব রোগীদের আইসিইউতে রাখা হয়। পরম মমতা দিয়ে তিলে তিলে সুস্থ করা হয় তাদের।
‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় রোগীরা ভয়ে ডাক্তারকে অনেক কিছু বলতে পারেন না। এই সম্পর্ককে সহজ করতে আজ আমরা জিবিএস ভাইরাসে আক্রান্তদের এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। কারণ এরা আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। তাছাড়া তাদের লড়াইয়ের গল্পটা একটু অন্য রকম। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা একটা বার্তা দিতে চাই। দেখাতে চাই ডাক্তার রোগীর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত। আর আমাদের হাসপাতালে কেমন।’ বলেন ডাক্তার উজ্জ্বল কুমার মল্লিক।
তন্ময় নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘একদিন সকালে কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার স্ত্রীর হাত-পা অবশ হতে শুরু করে। ঢাকা মেডিকেল ঘুরে এখানে ভর্তি করাই। এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছি। তাও সম্পূর্ণ সুস্থ করাতে পারিনি। ’
আনোয়ার নামের এক রোগীর রিকশাচালক বাবা ইতিমধ্যে জায়গা-জমি বিক্রি করে পথে বসেছেন।
চিকিৎসক স্বামীকে নিয়ে এসেছেন এক বৃদ্ধা। চোখে-মুখে তার যুদ্ধ জয়ের আনন্দ, ‘কী বলবো বাবা। এখানের ডাক্তাররা যে কেমন, তা বলে বোঝাতে পারবো না। উজ্জ্বল স্যারের কথা শুরু করলে শেষ করা যাবে না। জেডি স্যার (জয়েন্ট ডিরেক্টর), আসাদ স্যার, মিলন স্যার…ওনারা আমাদের কাছে দেবতা।’