ত্রিশ হাজার শ্রমিকের জীবন-পাথরের কঠিন লড়াই
এস কে দোয়েল :
প্রতিদিন ভোর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে জীবনের সাথে পাথরের লড়াই। পানকৌড়ি পাখির মতোই জলে ডুবে ডুবে নুড়ি পাথর তুলে দলবাঁধা শ্রমিকরা। ১০ কিলোমিটার জুড়ে শ্রমিকরা দল বেঁধে বাতাসে ফুলানো গাড়ির চাকার টিউব, লোহার চালনি, পাথর শনাক্তের জন্য লোহার রড নিয়ে কোথাও এক বুক, কোথাও বা হাঁটুপানির নিচ থেকে নুড়ি পাথর উত্তোলন করে পানিতে ভাসানো টিউবে রাখা ঢাকিতে রাখা হয় সে পাথর। পরে ঢাকি ভরা হলে দু’কাঁধে বাইক করে তীরে এনে জমা করে। সন্ধ্যায় মহাজনের কাছে বিক্রিলব্ধ অর্থে আহার জোটে স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজনের। এ চিত্র দেশের উত্তর সীমান্তের কূল ঘেষা নদী মহানন্দার। দুুই দেশের সীমান্তের বুক চিরে বয়ে যাওয়া এই মহানন্দায় পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ করে বেঁচে আছে হাজার হাজার শ্র্রমিক।
কিন্তু জীবিকার এই লড়াইও নিরবচ্ছিন্ন থাকে না ওপারের বিএসএফের কারণে। প্রতিবেশী ভারতের সীমান্ত টহলদার বাহিনীর বাধা, তাড়া, মারধরের ঘটনা ঘটে। কখনো বা তাদের গুলি করে কেড়ে নেয় শ্রমিকদের কারও জীবন। কখনো সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতীয় পণ্য ও গরু-মহিষ পাচারকে কেন্দ্র করেও বিভিন্ন সময় বন্ধ হয়ে যায় পাথর উত্তোলন। আর তখন থমকে যায় শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহের পথ।
শ্রমিকদের পরম ভাগ্যস্থান বলা হয় মহানন্দাকে। নদীটি ভারতের ফুলবাড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের পঞ্চগড় তেঁতুলিয়ায় প্রবেশ করে ২০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে আবার ঢুকে গেছে ভারতে। এর মূল উৎপত্তি ভারতের দার্জিলিংয়ের ২০৬০ মিটার উঁচু মহালিদ্রাম পাহাড়ে। বর্ষা মৌসুমে প্রবল বর্ষণে নদীর তীব্র স্র্রোতে ভেসে আসে ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের নুড়িপাথর। এই পাথরেই জড়িয়ে গেছে এ উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের জীবন। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে জানান, সারা দিনে একজন শ্রমিক গড়ে ২০-২৫ সিএফটি পাথর তুলতে পারেন। কখনো কম হয়। গড়ে দিন মুজুরি পড়ে ৪শ থেকে ৫শ টাকা।
মহানন্দার এই পাথরের সাথে মিশে গেছেন নারীরাও। তারাও খুঁজে নিয়েছেন কর্মসংস্থান। তারাও পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নদীতে নেমে পড়েন পাথর সংগ্রহে। দিন হাজিরার কাজ করেন শতশত নারী শ্রমিক। তারা ভোর হলেই গৃৃহের কাজকর্র্ম সেরে স্বামী সন্তানদের খাইয়ে বের হয়ে যান কাজে। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাথর নেটিং, ভাঙা, লোড-আনলোড এর কাজ করেন। পুুরুষ শ্রমিকদের সমান কাজ করলেও মুুজুুরি ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্য। দিন শেষে গাঁধার খাটুনি খেটেও এসব নারী শ্রমিকের আঁচলে আসে দিনে আড়াইশ থেকে ৩শ টাকা।
২৪ অক্টোবর/১৭ বুধবার দুপুরে শ্রমিকদের পাথরের জীবন সংগ্রাম দেখতে যান এই প্রতিবেদক। কথা বলেন প্রবীণ বয়সী হকিকুলের সাথে। বাড়ি সীমান্তের নিকটস্থ কৃষ্ণকান্ত জোত গ্রামে। এ গ্রামের আরো কয়েকজন রয়েছে। দিনভর দলবেঁধে কাজস ওরা। কথা হয় দুই সন্তানের জনক জামালের সাথে। ঘরে তার স্ত্রী সন্তান। মেয়ে ৭ম শ্রেণি আর ছেলে কেজি নার্সারীতে পড়ে। দিনভর এই পাথরের সাথে সংগ্রাম করে দিনশেষে মহাজনের কাছে পাথর বিক্রি করে পরিবারের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষাসহ যাবতীয় মৌলিক চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করে। নদীর তীরেই পাথর নেটিং ও মেশিনে পাথর ভাঙার করতে দেখা যায় নারী শ্রমিকদের। আয়মনা জরিনার মতো নারীদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই জীবন যুদ্ধে পরিবার পরিজনদের আহার জুটে। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জুটে।
শ্রমিকদের এই ঘাম ঝরানো শ্রমে উত্তোলিত পাথর বিক্রি হয় সারাদেশে। শহরে শহরে গড়ে উঠে আলিশান ভবন কিংবা বাড়ি। কিন্তু পাথর শ্রমিকদের ভাগ্যে সুফল মেলে এর সামান্যই। মহনন্দার পাথর, বালু আর সিলিকা বালিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারলে বদলে যেতে পারে অর্থনীতির চাকা। তাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে হাজার হাজার বেকারের।
উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শাহিন বলেন, এই পাথর ও বালি কাজে লাগানোর জন্য সরকারিভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলে শ্রমিকরা খুব লাভবান ও তাদের কর্মসংস্থানের সুবিধা হতো। আর এই নদী মহানন্দা হাজার হাজার মানুষের জীবিকার সন্ধান দিয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার খেটে খাওয়া মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে এ নদীর স্রোতে ভেসে আসা ছোট ছোট পাথর।