পর্যটনকন্যা তেঁতুলিয়া মোড়াল ফলক ও প্রকৃতির সৌন্দর্যে দৃষ্টি কাড়বে পর্যটকদের
এস কে দোয়েলঃ
চিত্ত-বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র এখন মানচিত্রের কোণে তেঁতুলিয়া। মানচিত্রের সবার উপরে থাকায় একনামে চিনে সীমান্ত বেষ্টিত পর্যটনখ্যাত এ জায়গাটি। প্রতিবছর টেকনাফের সাগর দেখতে যেমন লাখ লাখ দেশি-বিদেশী ভ্রমন পিপাসুরা পাড়ি জমান। তেমনি টেকনাফের অপর প্রান্ত উত্তরের তেঁতুলিয়ার জিরোপয়েন্ট দেখতেও ছুটে আসে হাজার পর্যটক। এ বছর সবুজ প্রকৃতির মায়াবি নিবির মুগ্ধতা যেমন পর্যটকদের প্রফুল্লিত করবে তেমনি নানান মোড়াল ফলকের সৌন্দর্যও দৃষ্টি কাড়বে বেড়াতে আসা অতিথিদের। উত্তরে আকাশ চুম্বী হিমালয়, মেঘকন্যা কাঞ্চনজঙা আর দার্জিলিংয়ের অপরূপ সৌন্দর্য শোভা উপভোগ করতে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক পর্যটক ভ্রমন করেন ভারত ও নেপালে। সেই আকাশ চুম্বী পর্বতশৃঙ্গ হিমালয়, কাঞ্চনজঙ্গা আর দার্জিলিংকে কাছ থেকে দেখা যাবে তেঁতুলিয়ায় আসলেই। নির্ভেজাল প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাস যেমন শরীর-মন জুড়িয়ে যাবে, তেমনি এখানকার সুস্বাদু পানি, খাবারও দেহতৃপ্তি এনে দিবে পর্যটকদের।
বৃহত্তম পার্বত্য চট্টগ্রামের মতোই সবুজ চায়ের অঞ্চল মনে করা হয় এখন তেঁতুলিয়াকে। তিনদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে প্রতিবেশী ভারত। দেশটির কাছে সাতরাজার ধনের মতো মূল্য তেঁতুলিয়া। সেভেন সিস্টার মূল ফটক সীমান্তবর্তী এই ছোট্ট নৈসর্গিক পর্যটন শোভিত এ অঞ্চলটি। সীমানা জুড়ে ভারতীয় সবুজ চা-বাগান, কাটাতারের বেড়া, সার্চলাইট, সুউচ্চ টাওয়ার আর কর্মরত চা শ্রমিকদের পাতা কাটার দৃশ্যও মুগ্ধ করবে যে কাউকে। মুগ্ধ করবে হাজার হাজার শ্রমিকদের পাথর উত্তোলনের দৃশ্য। ভারতের দার্জিলিংয়ের ২০৬০ মিটার উঁচু মহালিদ্রাম পাহাড় হতে প্রবাহিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বয়ে আসা নদী মহানন্দা। দুই দেশের সীমানার বুক চিরে প্রবাহিত এই নদীর তীরে দাঁড়িয়েই দেখা যাবে গগণচুম্বী হিমালয় পর্বতশৃঙ্গ, মেঘকন্যা কাঞ্চনজঙা আর দার্জিলিংয়ের দৃষ্টি নন্দন রূপ ।
সন্ধ্যার আঁধারে দার্জিলিং চুড়ার ঢালু বেয়ে গাড়ি চলাচল। কখনো দার্জিলিংয়ের মাথায় উড়ে আসছে পাখির মতো বিমান। ঢালু পাহাড়ের পথ জুড়ে রঙিন ল্যাম্পস্টের আলো। নদীর তীর ঘেষা ভারতের কাটাতারের বেড়ার সাথে সার্চলাইটের আলো। সে আলোয় ১৫ কিলোমিটার জুড়ে মহানন্দাকে মনে হবে গড়ে উঠা কোন এক আধুনিক শহর। নেমে আসা সন্ধ্যার সূর্যাস্ত মনে হবে সাগরকন্যা কুয়াকাটার সূর্যাস্তের অবিকল নান্দনিক রূপ। মধ্য দুপুরের মাথার উপর সূর্যের কিরণে হীরের মতো জ্বল জ্বল করে হাসতে দেখা যাবে মহানন্দার চরের একেকটি বালিকণা। মন ছুটে যাবে বালুচরে হাটতে। পায়ের নিচে বালির ঝিরঝির শিহরনে আরেক অনুভূতিতে মোহিত করবে হিমালয়ের এই রাজলক্ষী মহানন্দা।
দেশের উত্তরের পর্যটনকন্যা তেঁতুলিয়া দর্শনে প্রতি বছর ছুটে আসেন হাজার হাজার ভ্রমন পিয়াসী পর্যটক। প্রাকৃতিক অপরুপের সৌন্দর্য্য লীলাভূমি উপভোগ করতে আসতে হলে প্রথমেই আসতে হবে পঞ্চগড়ে। পঞ্চগড়কে হিমালয়কন্যা বলা হলেও তেঁতুলিয়াকে বলা হয় পঞ্চগড়ের সৌন্দর্যের রাজকন্যা। তাই তেঁতুলিয়ায় প্রবেশ পথে নজর কাড়বে জাতীয় মহাসড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রোড। যেকোন যানবাহনে আসার সময় দেখা মিলবে ৭১ এর মুক্তাঞ্চল ফলক। মুক্তাঞ্চলের সুদৃশ্য গেট জানিয়ে দিবে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কোন পাকসেনা এ অঞ্চলেই প্রবেশ করেনি বলেই স্থানটি মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এর কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়বে অভ্যর্থনার ‘স্বাগতম তেঁতুলিয়া’ নামের সুদৃশ্য গেট।
প্রবেশদ্বার পেরুলেই চোখে পড়বে জাতীয় মহাসড়কের ধারেই জায়গায় জায়গায় মনকাড়া বেশ মোড়াল ফলক। জাতীয় এই মহাসড়কেই রয়েছে দুই কিংবদন্তী ব্যক্তির ভাস্কর্য। মাঝিপাড়া বাইপাস রোডে দৃষ্টি পড়বে টাইচ ফ্রেমে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল মোড়াল ভাস্কর্য। বুড়িমুটকি বাইপাস সড়কে স্থাপিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্য। এ দুটি স্থানটি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সরণী বলে পরিচিত সবাই। এর উত্তরে বাংলাবান্ধায় রয়েছে বিশাল জিরোফলক। বিশাল এই জিরো ফলকই হচ্ছে বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট। বাংলাদেশের শেষ সীমানা। এখানে গড়ে উঠেছে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর। ইমিগ্রেশন সুবিধা চালু হওয়ায় এ বন্দর দিয়ে প্রবেশ করা যায় ভারত, নেপাল, ভূটান ও চীনে। পাসপোর্ট ভিসা থাকলে অনায়েসেই ঘুরে আসা যায় ভারতের শিলিগুড়ী, দার্জিলিংসহ নানান দর্শনীয় স্থান এবং নেওয়া যায় উন্নত চিকিৎসা সেবা।
পর্যটনের বর্তমান সময়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে উপজেলা প্রশাসন তেঁতুলিয়া প্রবেশদ্বার হতে শুরু করে বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়কের বিভিন্ন দৃশ্যপট স্থানে স্থাপন করেছেন নানান ভাস্কর্য। এসব ভাস্কর্য চোখ জুড়াবে দর্শনার্থীদের। এসব ভাস্কর্যের মধ্যে মাঝিপাড়া বাইপাসে সারস পাখি, কালান্দিগঞ্জ বাজারে বাংলাদেশের প্রথম ১টাকা নোট, ভজনপুরে শাপলা এবং তিরনই হাটে মাছসহ নানান ইতিহাস নির্ভর ভাস্কর্য। এদিকে তেঁতুলিয়ার একমাত্র পিকনিক স্পট জেলা পরিষদ ডাকবাংলোও ভাস্কর্য স্থাপনের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। পর্যটকদের দৃষ্টি আকষর্নে বেশ কিছু কৃত্রিম ভাস্কর্য ও পশু প্রাণি স্থাপনসহ শিশুদের খেলনা স্থাপন করে দৃষ্টি নন্দন ফোয়ারা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও পর্যটকদের ঘুরে দেখার মতো রয়েছে গ্রীণ টি গার্ডেন, দর্জিপাড়া কমলাবাগান, রওশনপুর আনন্দধারা পার্ক, টি ফ্যাক্টরি, মিনা বাজার, সমতল ভূমিতে পাথর কোয়ারি এবং ভিতরগড়ের ঐতিহাসিক প্রত্মততœনগরী ও মহারাজা দিঘী।
দেশের উত্তর সীমান্তের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এ প্রশাসনের নির্বাহী কর্মকর্তা মো.সানিউল ফেরদৌস তেঁতুলিয়ায় যোগদানের পর হতেই নানামুখী সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড দক্ষতার সাথে করে প্রশংসিত হয়েছেন। গণমাধ্যম হতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে অভিষিক্ত হন চৌকষ এ কর্মকর্তা। অন্যদিকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এসময়ের জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শাহিন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তেঁতুলিয়াকে বাংলাদেশের অন্যতম জননন্দিত স্থান হিসেবেই পরিচিতি তুলে ধরেন। সীমান্তবর্তী এ উপজেলাটিকে কিভাবে পর্যটন শিল্পনগরী গড়ে তোলে দেশ-বিদেশে ভ্রমন পিপাসুদের কাছে পরিচিত করা যায় সে পরিকল্পনা নিয়ে নির্বাহী অফিসারের সাথে যৌথ উদ্যোগে এবার পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরেছেন তেঁতুলিয়াকে।