রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশই দেরি করছে: অভিযোগ মিয়ানমারের
নির্যাতনের মুখে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে বাংলাদেশ দেরি করছে অভিযোগ মিয়ানমারের।
আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীগুলোর কোটি কোটি ডলার সহায়তা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে- এ শঙ্কায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ বিলম্বের পথ বেছে নিয়েছে বলেও দাবি দেশটির।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চির মুখপাত্র জাউ তায় সাংবাদিকদের কাছে এ অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণা অনুসারে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে প্রস্তুত রয়েছে মিয়ানমার। কিন্তু বাংলাদেশ এ শর্ত না মেনে দেরি করছে। এই দেরি করার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সহযোগিতা আদায় করতে চায়। আন্তর্জাতিক সহায়তার অর্থ হিসেবে কোটি কোটি ডলার পাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় না বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত তারা (বাংলাদেশ) ৪০ কোটি ডলার (৪০০ মিলিয়ন) পেয়েছে। তারা এতো বেশি অর্থ পাওয়ায় আমরা আশঙ্কা করছি শরণার্থীদের (রোহিঙ্গা) প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হতে দেরি হবে।
মুখপাত্রের এ বক্তব্য বুধবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চির কার্যালয়ের মহাপরিচালক জাউ তায় বলেন, 'প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা প্রস্তুত কিন্তু অন্যপক্ষ (বাংলাদেশ) এখনও তা (শর্ত) মেনে নেয়নি। ফলে প্রত্যাবাসন শুরু হতে দেরি হচ্ছে।
মুখপাত্র আরও বলেন, 'তারা আন্তর্জাতিক ভর্তুকি পাচ্ছে। আমরা আশঙ্কা করছি, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তাদের হয়ত অন্য কোনো বিবেচনা রয়েছে।'
রাখাইন রাজ্যের গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে গত ২৫ আগস্ট থেকে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের কারণে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে আছে গত কয়েক দশক ধরে।
বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে, মানবিক কারণে আপাতত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হলেও তাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই; সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত।
সু চির সরকার দাবি করে আসছে, যেসব রোহিঙ্গা নিজেদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ দিতে পারবে তাদেরকেই ফিরিয়ে নেয়া হবে। মুখপাত্র দাবি করেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তালিকার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। তিনি বলেন, 'তৃতীয়বারের মতো আলোচনার পর আমরা প্রত্যাবাসনে যাব। আমরা উদ্বিগ্ন এ প্রক্রিয়ায় দেরি হতে পারে। যদি বেশি দেরি হয় তাহলে আশঙ্কা করছি ইচ্ছাকৃতভাবে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে যে, আমরা তাদের ফিরিয়ে আনতে চাইছি না। মিয়ানমার পুলিশ প্রধান বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে শরণার্থীদর তালিকা চেয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা তা পাইনি। তারা (বাংলাদেশ) বলেছিল তালিকা ইমেইলে পাঠাবে। এই তালিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের কাছে পালিয়ে যাওয়া লোকের সঠিক সংখ্যা রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ। কোনওভাবেই এটি সম্ভব নয়।
গত সপ্তাহে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে সীমান্ত মৈত্রী পোস্ট স্থাপনের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়। দেশটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ওই স্মারকে সই করেন।
১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে যে প্রত্যাবাসন চুক্তি করেছিল, তার আওতায় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে সে সময় ফিরিয়ে নিয়েছিল তারা। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে ‘মিয়ানমার থেকে আসা’ বলে চিহ্নিত করা হলেও তাদের আর তারা ফিরিয়ে নেয়নি।
গত আগস্টে রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মধ্যে মিয়ানমারের তরফ থেকে বলা হয়, ১৯৯২ সালের চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রাখাইনের মুসলমানদের ফিরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত।
এর ধারাবাহিকতায় সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় এলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়।
১৯৯২ সালের চুক্তি এখন আর ‘বাস্তবসম্মত নয়’জানিয়ে ওই বৈঠকে নতুন একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এগিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। এ বিষয়ে মিয়ানমারের জবাব এখনও বাংলাদেশ পায়নি।
গত ৯ অক্টোবর ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের চুক্তির নীতিমালা ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার তুলনায় অনেকটাই আলাদা। সুতরাং ওই চুক্তি অনুসারে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়।
১৯৯২ সালের ওই চুক্তির চতুর্থ দফায় রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়, যাদের কাছে মিয়ানমারের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জাতীয় নিবন্ধন কার্ড থাকবে অথবা যারা জাতীয়তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারের যে কোনো দপ্তরের দেয়া কোনো নথি দেখাতে পারবে এবং যারা মিয়ানমারে তাদের বসবাসের প্রমাণ দিতে পারবে- তাদের সবাইকে ধাপে ধাপে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার।
কিন্তু গত মাসে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আসা একজন কূটনীতিক বলেন, যে অবস্থায় এই মানুষগুলো মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে, তাতে তাদের কাছে পরিচয়পত্র আশা করা কঠিন।
তাছাড়া রোহিঙ্গাদের কাছে জাতীয় পরিচিতির যেসব কাগজপত্র ছিল, গতবছরই সেগুলো বাতিল করে দিয়েছে মিয়ানমার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন গত ২৬ অক্টোবর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে ফোন করে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন কোনো শর্ত না দিয়ে ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন তিনি।
এর আগে এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, এখনকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। তবে আমরা মনে করি, ১৯৯২ সালের সমঝোতা যে প্রিন্সিপাল মেনে হয়েছিল, তাকে ভিত্তি ধরে এবারও আলোচনা এগিয়ে নেয়া যায়।
তার ওই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটও পরে বলেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির সঙ্গে নতুন বিষয় যোগ করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা ভাবতে পারে।