শ্রীপুরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা
টি.আই সানি,শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধিঃ
সবে বেলা সাড়ে ১২ টা,কিন্তু মাদ্রাসা ছুটি। একটা কাকপক্ষিও নেই মাদ্রাসায়। একই মাঠে সরকারি প্রাইমারি স্কুল চলছে দিব্বি। মাদ্রাসা মাঠে দাঁড়িয়ে সুপার কে ফোন দেওয়া হলে উত্তর আসে তিনি মাদ্রাসাই আছেন। মিনিট দশ পর হন্তদন্ত হয়ে তিনি ছুটে আসেন। মাদ্রাসা ছুটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন আজকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন তেমন কোনো কারণ নেই তবে যেহেতু পরীক্ষা চলছে সেহেতু আমাদের মাদ্রাসা থেকে ২জন শিক্ষকের পরীক্ষার হলে ডিউটি রয়েছে তাই মাদ্রাসা ছুটি দিয়ে দিয়েছি। পাশের সরকারি প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক বললেন এই মাদ্রাসা প্রায়ই বরোটা একটার দিকে ছুটি হয়ে যায়।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের সাইটালিয়া মাদ্রাসায় সরেজমিন গেলে এমনটায় দেখা যায়। এটা শুধু যে এই মাদ্রসার চিত্র তা কিন্ত নয়। শ্রীপুরে মোট ৩৮টি এমপিওভুক্ত ও ৪টি নন এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা রয়েছে। যার অধিকাংশ মাদ্রাসার চিত্রই এমন।
শ্রীপুর ভাংগাহাটি রাহমানিয়া কামিল মাদ্রাসা,ধনুয়া বড়চালা দাখিল মাদ্রাসা,ধনুয়া কাচারীপাড়া আহমাদিয়া দাখিল মাদ্রাসা,সাইটালিয়া দাখিল মাদ্রাসা,চকপাড়া হাজী নজীব উল্লাহ দাখিল মাদ্রাসা,গাজীপুর সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা,গাড়ারণ খলিলিয়া বহুমূখী ফাজিল মাদ্রাসা,বরামা ইসলামীয়া ফাজিল মাদ্রাসা, বরামা বালিকা দাখিল মাদ্রাসা,বিন্দুবাড়ি গাউসুল আজম সিনিয়র মাদ্রাসা সহ দাখিল, আলিম ও ফাজিল পর্যায়ের মোট ৩৮ টি মাদ্রাসার অধিকাংশ সুপার,প্রিন্সিপাল ও ম্যানেজিং কমিটির স্বেচ্ছাচারিতা,অদক্ষতা,অনিয়ম,দুর্নীতি ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এই উপজেলার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা।
দাখিল মাদ্রাসার প্রধান সুপারেন্টে-েন্ট,আলিম ও ফাজিল মাদ্র্রাসার প্রধান হলেন প্রিন্সিপাল। যাদের সবাই মাদ্রাসা থেকেই শিক্ষালাভ করে সরকারি ভাবে নিয়োগের মাধ্যমে এই পদে আসীন হয়েছেন। প্রত্যেকেই এলাকার বিশিষ্টজন ও হুজুর। তাদের মধ্য থেকে অনেক হুজুরদের সারা দেশব্যপী ওয়াজ করার সুনামও রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে এই সুপার ও প্রিন্সিপাল হুজুরদের বিরুদ্ধে। ঠিকমত পাঠদান না দেওয়া,পরীক্ষায় অনৈতিকতা ও প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা সহ রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। এমনকি কয়েকটি মাদ্রাসার প্রধান ও ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে সরকারি বিভিন্ন অনুদান, প্রতিষ্ঠানের নিজ¦স্ব ফা-সহ মাদ্রাসার জমি আত্মসাৎ করারও অভিযোগ রয়েছে।
গাড়ারণ খলিলিয়া বহুমূখী ফাজিল মাদ্রাসা শ্রীপুরের একটি অতি প্রাচীন মাদ্রাসা। যা ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাদ্রাসায় বর্তমানে অধ্যায়ানরত শিক্ষার্থী রয়েছে মোট ৪১৭জন। মোট ৩০ জন দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষকম-লী দ্বারা পরিচালিত হলেও দিনদিন কমে যাচ্ছে এর শিক্ষার্থী। দাখিল ও আলিম পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে কিন্তু শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব কম। মাদ্রাসার অবকাঠামোর অবস্থা এতটায় নাজুক যে ওয়াশরুম ও পয়:নিস্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই উপযুক্ত শ্রেণী কক্ষের সু-ব্যবস্থ। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি যদিও মাদ্রাসা কিন্তু মেয়ে শিক্ষার্থীদের নামায বা কমনরুমের কোনো ব্যবস্থা নেই। বিজ্ঞানাগার ও লাইব্রেরী দূরারোগ্য রোগীর ন্যায় জুবুথুবু হয়ে পড়ে রয়েছে। ছোট্ট একটি রুম সেটিতেও চারিপাশে বড় বড় ফাটল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদ্রাসা আশপাশের অনেকের অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং কমিটির কারণেই মূলত এই দূরাবস্থা। সরকারি অনুদানসহ মাদ্রাসার ফা-ের টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে কমিটির সভাপতি মো. বুলবুল হোসেনের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় খোকা মিয়া জানান, ডিগ্রী পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি যদি টু পাশ হয় এবং প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ্যাৎ প্রিন্সিপাল যদি অবৈধ হয় তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানের যে কি অবস্থা হবে তা সহজেই বুঝা যায়। তিনি আরো জানান বর্তমান প্রিন্সিপাল অবৈধ হওয়ার কারণে তার বেতন বন্ধ রয়েছে।
সভাপতি মো.বুলবুল হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, তিনি সভাপতি হওয়ার পর উত্তর পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদ মেরামত, বালু দিয়ে মাঠ ভরাটসহ নানাবিধ উন্নয়নমূক কাজ করেছেন। পর পর ৩ বার সভাপতি থেকে মাদ্রাসার ভালোই সব সময় চেয়েছেন কিন্তু সরকারি বড় ধরণের কোনো অনুদান না পাওয়ায় অবকাঠামোগত কোনো কাজ করতে পারেনি।
এদিকে গাজীপুর সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার নামে দানকৃত মোট জমি ছিলো প্রায় ৯০ বিঘা কিন্তু তার প্রায় ৩৯ বিঘাই বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে।
মাদ্রাসার পাশেই বাড়ি পুলিশের সাবেক ডিআইজি মো. তোফাজ্জল হোসেন তিনি জানান, মাদ্রাসায় যারা জমি দান করেছে তাদের জমি কখনও বিক্রি করা যাবে না চিরস্থায়ী দান এই শর্তেই জমিদাতারা জমি দান করেছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে মাদ্রাসায় এডহক কমিটি। এই এডহক কমিটির উপর নির্ভর করেই প্রিন্সিপাল মাদ্রাসার প্রায় ৩৯ বিঘা জমি বিক্রি করেছে যেই টাকার কোনো হদিস নেই। যেহেতু কোনো কমিটিই নেই সেহেতু তিনি যা খুশি তাই করছেন।
মাদ্রাসায় জমিদাতা মোবারক হোসেন বলেন, মাদ্রাসায় ছাত্রছাত্রীর চেয়ে শিক্ষক বেশি। প্রিন্সিপালের দুর্নীতির কারণে এলাকার কোনো অভিভাবক চায় না তাদের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়–ক।
মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মো. আব্দুল রাজ্জাক জেহাদী জানান, কোনো প্রকার অনিয়ম ও দুর্নীতি আমি করিনি। ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি নিয়ে কিছু জমি বিক্রি করে মাদ্রাসায় একটি দ্বিতল ভবন করেছি। দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য, তবুও এলাকার অনেকের মন পাচ্ছি না। আপনার সাংবাদিকরা যা পারেন লেখেন, কতইতো লেখালেখি করল, এগুলো কোনো ব্যাপার না।
অভিযোগ রয়েছে বরামা বালিকা দাখিল মাদ্রাসার সুপার মো. নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধেও। ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসার আয়-ব্যায়ের ব্যাপক গড়মিল থাকায় ম্যানেজিং কমিটি থেকে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির অন্যতম সদস্য মাদ্রাসার শিক্ষক মো. শহিদুল্লাহ জানায়, আমাদের তদন্তে স্পষ্টই প্রমাণিত হয়েছে মাদ্রাসার সুপার ৪ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে মাদ্রাসা থেকে সড়িয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট ম্যানেজিং কমিটির কাছে জমা দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
মাদ্রাসার এই সব অনিয়ম,দুর্নীতি ও জমি আত্মসাতের বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামের সাথে কথা বললে তিনি জানান, এটা ঠিক বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা স্কুলের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। তবে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি এনটিআরসি গ্রহণ করায় আশা করছি এখন দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। মাদ্রাসার নামে দানকৃত জমির বিষয়ে তিনি বলেন কোনো অবস্থাতেই দানকৃত জমি বিক্রি করার কোনো নিয়ম নেই। কেউ করে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অন্যদিকে,এনটিআরসি কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগের চাহিদা চাওয়া হলেও কিছু মাদ্রাসার তা না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান,ইংরেজী, অংক ও আইসিটির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনেক মাদ্রাসায়ই নেই কোনো শিক্ষক। ফলে দিনের পর দিন ওই সমস্ত মাদ্রাসায় শিক্ষকদের শুণ্য তালিকা থেকে যাচ্ছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান দিনদিন চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
কয়েকটি মাদ্রাসায় সরেজমিনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপকালে নিশ্চিৎভাবেই বুঝা যায় শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র মাদ্রাসায় যাওয়া আসা ছাড়া আর কিছুই লাভ হচ্ছে না। নবম দশম শ্রেণীর এক থেকে পাঁেচর মধ্যে কিছু শিক্ষার্থীদেরকে ‘আমি ভাত খাই না,আমি আপনাকে চিনি না,আমি ভালো নেই ও আমরা ভালো ইংরেজী পারি না’ এই ধরণের অত্যন্ত সহজ কিছু বাংলার ইংরেজী অনুবাদ করতে বলা হলে তাদের সবাই এগুলোর সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। বলা বাহুল্য, সবাই তাদের ইংরেজী শিক্ষকের খুব গুণকীর্তন করেছে।
শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়,উপজেলার সবগুলো মাদ্রাসার ইংরেজী শিক্ষক পাস কোর্সের ১শ কিংবা ৩শ নম্বরের ইংরেজী নিয়ে ডিগ্রি সম্পন্নকারী শিক্ষক। কাজেই সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি বুঝা তাদের পক্ষে দূরূহ ব্যাপার। তাছাড়া আগে মাদ্রাসায় ইংরেজী ১ম পত্র ২য় পত্র মিলিয়ে ১ শ নম্বরের ইংরেজী ছিলো কিন্তু এখন স্কুল কলেজের মতো ২শ নম্বরের করা হয়েছে। যা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উভয়ের জন্যই কঠিনতর হয়েছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার এই অবনতি ও চরম দুরাবস্থা নিয়ে কথা হয় অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে মানবাধিকার শিক্ষা নিয়ে পিএইচডিতে অধ্যায়নরত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক খাইরুল ইসলাম স্যারের সাথে। স্যার বলেন, মাদ্রাসাগুলোতে সাধারণত ধর্মীয় শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে বর্তমানে সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বলাবাহুল্য যে এই গুরুত্বটা শুধুমাত্র কাগজে কলমে থাকলে চলবে না, বরং এর সঠিক বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে ইংরেজী বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ কতটা শ্রেণীকক্ষে বাস্তবায়িত হচ্ছে সেটার যথাযথ পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে।
বিশ^ায়নের এই যুগে ইংরেজি এখন শুধু আর ভাষা নয়। এটি একটি বড় দক্ষতা, একটি প্রযুক্তি। সুতরাং মাতৃভাষা সম্মৃদ্ধ করার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার গুরুত্বও মাদ্রাসার শিক্ষকদের অনুধাবন করতে হবে। এর গুরুত্ব অনুধাবন ও বিশ^াস করলেই মাদ্রাসার চলমান ইংরেজি সমস্যার অনেকাংশেই উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেন তিঁনি।