পুলিশ খুন মামলার প্রধান আসামী মোস্তফা মেয়র এখন দূর্নীতির রাজা!
বিশেষ প্রতিবেদক :
ছাগলনাইয়ায় পুলিশকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামী হোন্ডা চোর খ্যাত মো. মোস্তফা মাত্র বছর কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি এখন ফেনীর ছাগলনাইয়া পৌরসভার মেয়র। নগর পিতার জায়গায় হয়ে উঠেছেন দুর্নীতি ও অনিয়ম, অসামাজিক কার্যকলাপ, দখলের রাজা। মেয়রের কর্মকান্ডে ক্ষুব্দ কাউন্সিলররা প্রতিবাদ করলে তারা এখন একঘরে।
মামলার বিবরণ, স্থানীয় এলাকাবাসী, কাউন্সিলর ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ছাগলনাইয়া কলেজ রোড়স্থ বিএনপির নতুন অফিস উদ্বোধনকালে উপজেলা শহরের বিভিন্ন সড়ক থেকে বিএনপির মিছিল আসা অবস্থায় কিছু আ.লীগ নেতা-কমী মিছিল নিয়ে মুখোমুখি হলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এসময় পুলিশ উভয় দলের মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে আনে। শহরের চৌরাস্তায় পুলিশ টহলরত থাকা অবস্থায় বাঁশপাড়া গ্রামের ইদ্রিস মিয়ার ছেলে মো. মোস্তফার নেতৃত্বে একদল অস্ত্রধারী পুলিশকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে কনস্টেবল আবদুল বাসেত কপালে গুলিবিদ্ধ হয়। এসময় পুলিশ অস্ত্রধারীদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করলে তারা পালিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় কনস্টেবল আবদুল বাসেতকে উপজেলা সাস্থ্য কমপ্লেক্্ের নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মো. মোস্তফাকে প্রধান আসামী করে ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ৩০/৪০ জনকে আসামী করে তৎকালীন ছাগলনাইয়া থানার এস.আই আলতাফ হোসেন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।
পুলিশ খুনের মামলায় আসামী হয়ে পার পেয়ে গেলে মোস্তফা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। তার বড় ভাই বর্ষিয়ান নেতা ফয়েজ আহাম্মদ মারা যাওয়ায় পর বড় ভাইয়ের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে আ.লীগ থেকে মেয়র মনোনয়ন ভাগিয়ে নেয় ও একতরফা নির্বাচনে জয়ী হয়। দায়িত্ব গ্রহণের ১৭ মাসেই মোস্তফা হয়ে উঠে দূনীতির রাজা। ছাগলনাইয়া পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মো. মোস্তফা পৌর এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় না দিয়ে গোপনে নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে নামকাওয়াস্তে কাজ করে লাখ লাখ টাকা আতœসাত করেছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ আতœসাত ও বিচারপ্রার্থী মহিলাদের সাথে অশোভন আচরণেরও অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, গত কিছুদিন পূর্বে পৌর ষ্টেশনের ইজারা বৈধভাবে পূর্ব ছাগলনাইয়ার শরিফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি পেলেও তাকে না দিয়ে গোপনে উপজেলা বিএনপির সভাপতির সহযোগী আলাউদ্দিনকে দেন মেয়র। এছাড়া পৌর এলাকার ফল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দোকান ঘর বরাদ্দ দেয়ার নাম করে জনপ্রতি ২/৩ লাখ টাকা করে নিলেও তাদের দেয়া হয়নি কোন রসিদ। এছাড়া তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর গত ১৭ মাসে বিভিন্ন মাসিক সভা অনুষ্ঠিত হলেও কাউন্সিলরদের দেয়া হয়নি রেজুলেশনের কপি। এনিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কাউন্সিলর জানান, মাসিক সভায় তাদের কাছ থেকে সাদা কাগজে মাত্র স্বাক্ষর নেয়া হয়। এনিয়ে কথা বললে মেয়র মোস্তফা রাগান্বিত হয়ে বলেন, তোরা মাস শেষে শুধু ভাতার টাকা নিবি এর বেশী কিছু জানার অধিকার তোদের নেই। তারা আরো জানান, পৌর এলাকার মধ্যম মটুয়া রাস্তা সংস্কারের কাজ, মুন্সী পুকুর সংলগ্ন কালামের বাড়ীর সামনের কালভার্ট ও হাজী বাদশাহ মিয়ার বাড়ীর দরজায় মসজিদের সামনে ঈদগাহের উন্নয়ন কাজ পেয়েছেন মেয়রের পছন্দের লোক। পৌরসভার অধিকাংশ কাজ দেয়া হয় নির্দিষ্ট কয়েকজন ঠিকাদারকে। এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এডিবি’র অর্থায়নে (টেন্ডার নোটিশ নং ০২/২০১৬-১৭) ১৫টি প্রকল্পে কাজ শেষ করার কথা মেয়র সাংবাদিকদের বললেও মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের তথ্য পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা বলছেন, মেয়রের প্রকল্প কাগজে আছে, বাস্তবে নেই। তবে এপ্রসঙ্গে মেয়র বলেন, তিনি এডিবি থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা পেয়ে সাবেক মেয়র মো. আলমগীর বিএ’র আমলে রেখে যাওয়া ৭০ লাখ টাকা কর্জ ঠিকাদারদের পরিশোধ করেছেন।
তাছাড়া ছাগলনাইয়া থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় হোন্ডা চোর সিন্ডিকেটের তালিকায় তার নাম রয়েছে। ছাগলনাইয়ার বাঁশপাড়ার (পৌর শহর) বাসিন্দা ও প্রভাবশালী আ.লীগ নেতার ভাই হওয়ার সুবাদে একের পর এক মার্কেট জবর দখল ও পৌরসভার ভাড়া গাড়ি ব্যবহার করে দখল করা জায়গা ভরাট করার অভিযোগ রয়েছে মেয়র মোস্তফার বিরুদ্ধে।
এদিকে মেয়র মোস্তফার বিরুদ্ধে এক মহিলাকে শ্লীলতাহানি করারও অভিযোগও রয়েছে। গত কিছুদিন পূর্বে ৩ লাখ টাকা পাওনা টাকা আদায়ের বিষয়ে মেয়রের কাছে গেলে জোসনা আক্তার শাহেনা নামে ওই মহিলাকে শ্লীলতাহানি ও গভীর রাতে ইমুতে ফোন করে উত্ত্যক্ত করে মেয়র। এছাড়া এক স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা মোহরানার টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে মেয়রের নিকট গেলে তার সাথেও খারাপ আচরণ করা হয়।
এসব অভিযোগে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ছাগলনাইয়ায় সংবাদ সম্মেলন করেন পৌর মেয়র মো. মোস্তফা। বৃহস্পতিবার রাতে পৌর মেয়রের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মেয়র মো. মোস্তফা বলেন, আমি এক মুসলিম সভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। স্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে এসে পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করে জনপ্রতিনিধি হয়েছি। আমার আপন বড় ভাই ফয়েজ আহাম্মদ বিএ ছাগলনাইয়া উপজেলা আ’লীগের ৪০ বছরেরও অধিক সম্মানের সহিত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
আমার প্রতিটি পদক্ষেপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী নাসিম ও ফেনী জনমানুষের নেতা ফেনী-২ আসন এর সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীর পরামর্শে করে থাকি। আমি উড়ে এসে জুড়ে বসি নাই। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। কারও রক্তচক্ষুকে ভয় পেয়ে জনসেবা থেকে পিছু হটবো সে রাজনীতি করি না। আমি পৌরসভার শূণ্য তহবিল নিয়ে দায়িত্ব নিয়েছি। বিগত সময়কার মেয়রের অনিয়ম ও অগ্রিম বাজেট দেওয়া কাজগুলো সামলিয়ে অনেক কষ্টে পৌরবাসীর ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করছি।
আমার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি কুচক্রী মহলকে খুশি করতেই কয়েকটি পত্রিকায় আমার ও পৌরসভার বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, উদ্দেশ্য প্রণোদিত মনগড়া সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে। আমি এই সংবাদের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। আমি আমার কাউন্সিলরদের সাথে কোন প্রকার খারাপ ব্যবহার করি না। আমার পৌরসভায় মাসিক সভায় প্রত্যেকটি কাউন্সিলরের স্বাক্ষর রয়েছে। তাদের সাথে আমার সু-সম্পর্ক রয়েছে। পৌরসভার প্রত্যেকটি কাজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমাদের কাছে সংরক্ষণে রয়েছে। যা আপনারা প্রয়োজনে খোঁজখবর নিতে পারেন। ১৭ মাসে মাসিক সভার রেজুলেশন কাউন্সিলরদের না দেয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। মধ্যম মটুয়া কাজের বিষয়ে পত্রিকাগুলো যে মনগড়া সংবাদ প্রকাশ করেছে, তা সবই মিথ্যা। প্রকৃত ঠিকাদারকে নিয়মনীতি অনুসরণ করেই কাজ দেয়া হয়েছে। কাজ বাস্তবায়ন করছেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স বসর এন্ড ব্রাদার্স। সিএনজি ষ্টেশন ইজারা পাওয়ার বিষয়ে যে নাম উল্লেখ করেছে তা আদৌ সত্য নয়। নিয়ম মাফিক ইজারা পেয়েছেন সর্বোচ্চ করদাতা ঠিকাদার নেজাম উদ্দিন।
তিনি আরো বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র যতই হোক পৌরবাসীকে নির্ভয়ে সেবা দিয়ে যাব বলে আপনাদের মাধ্যমে তা পূর্ণব্যক্ত করলাম। এসময় উপস্থিত ছিলেন পৌর প্যানেল মেয়র মুন্সী নুর হোসেন, পৌর কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির ভূঁঞা, সামছুল হক, মহিলা কাউন্সিলর আলেয়া বেগম মঞ্জু, হাসিনা আক্তার, উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা জিয়াউল হক বাবলু প্রমুখ।
অপরদিকে সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে মেয়র মো. মোস্তফার দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ছাগলনাইয়া পৌরসভার অন্য কাউন্সিলরা। কাউন্সিলরদের পক্ষে পৌরসভার পশ্চিম ছাগলনাইয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোজহারুল ইসলাম মুসা, বাঁশ পাড়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামীলীগ নেতা হাবিবুর রহমান, মটুয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত লিখিত প্রতিবাদ লিপিতে কাউন্সিলরা অভিযোগ করে বলেন, পৌর কাউন্সিলরা এলাকার জনগণের রাস্তাঘাট, পুল-কালভাট, ড্রেন নির্মাণসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাদের ওয়ার্ড গুলোতে কাক্ষিত উন্নয়ন হয়নি অভিযোগ করে বলেছেন, মেয়র সাহেব তার পছন্দের ঠিকাদার ও পছন্দের এলাকায় নিজের ইচ্ছেমতো পৌরসভার অর্থে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত করেন। ওইসব কাজের মান নিয়েও এলাকাবাসীর প্রশ্ন রয়েছে বলে অভিযোগ করে বিবৃতিতে তারা আরো বলেছেন, মেয়র সাহেব কাউন্সিলরদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, পৌরবাসীর সঙ্গে অনৈতিক আচরণ, মাসিক সভার রেজুলেশান সরবহরাহ না করার অভিযোগ কাউন্সিলরদের। পৌরসভার বেশিরভাগ কাউন্সিলরদের সঙ্গে মেয়রের সমন্বয় না থাকার কথা জানিয়ে তারা বলেছেন, নিজেরা আওয়ামীলীগের একনিষ্ট কর্মী হলেও পৌরসভার যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডে তাদের ওয়ার্ডের জনগণ সর্বত্রই বঞ্চিত হচ্ছেন এবং পৌর মেয়র মো. মোস্তফা তাদের সঙ্গে বিরোধী দলের লোকের মতো আচরণ করেন বলেও অভিযোগ তাদের।