চীনের বিরোধিতায় রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষায় প্রস্তাবটি পাস হয়নি
চীনের প্রবল বিরোধিতায় মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়নি।
গতকাল জেনেভায় কাউন্সিলের ২৭তম বিশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের আনা প্রস্তাবটি ৩৩-৩ ভোটে পাস হয়েছে।
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানবিক ও মানবাধিকার সুরক্ষা-সংক্রান্ত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অনুরোধে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল গতকাল ‘মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক বিশেষ অধিবেশনটি ডেকে।
অধিবেশনে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একটি প্রস্তাবের খসড়া দেয়—তাতে সমর্থন জানায় সৌদিআরব।
বিশেষ অধিবেশন ডাকতে হলে ৪৭ সদস্যের কাউন্সিলে ন্যূনতম ১৬টি বা এক-তৃতীয়াংশ দেশের সমর্থন প্রয়োজন হয়। কাউন্সিলের ৩৩টি সদস্যদেশ এবং ৪০টি পর্যবেক্ষক দেশ বিশেষ অধিবেশন ডাকার প্রস্তাবে সমর্থন দেয়।
এর আগে ২০০৭ সালের অক্টোবরে কাউন্সিলের পঞ্চম বিশেষ অধিবেশনে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের গতকালের অধিবেশনটি ছয় ঘণ্টায় দুই পর্বে বিভক্ত ছিল।
জোয়াকুইন আলেক্সান্ডার মাজা মার্তেল্লির সভাপতিত্বে প্রথম পর্বে জাতিসংঘের মানবাধিকার–বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন ছাড়াও ৪৩টি দেশের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ও জেনেভায় জাতিসংঘে মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধি তিন লিন।
শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমন্বিতভাবে সমাধানের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিটি সই করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান তিনি।
দ্বিতীয় পর্বে ২৯টি দেশের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্তত ১২টি মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা বক্তৃতা দেন।
বক্তৃতা পর্ব শেষে প্রস্তাবটি নিয়ে সংক্ষেপে সৌদি আরব ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা কথা বলেন।
এরপর মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধি তিন লিন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবার জন্য সুরক্ষা অপরিহার্য, সেখানে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তাবটি বাজে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে যাচ্ছে তা ছাড়া প্রস্তাবে যা বলা হয়েছে, তা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল।
উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে জেনেভায় চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি মা ঝাওজু বলেন, দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়াই রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান।
এ সমস্যা সমাধানে চীনের দেয়া তিন ধাপের প্রস্তাবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও স্বাগত জানিয়েছে জানান তিনি।
দুই দেশ এ নিয়ে ২৩ নভেম্বর চুক্তি সই করায় চীন সন্তুষ্ট— এখন এটির বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ এই প্রেক্ষাপটে চীন মনে করে, কাউন্সিলে প্রস্তাব সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে না বরং পুরো প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে তাই চীন প্রস্তাবটি ভোটাভুটিতে দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। চীন বিপক্ষে ভোট দেবে বলেন তিনি।
জেনেভায় ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি রাজীব চন্দর বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সহযোগিতা করে আসছে ভারত।
দেশ দুটির মধ্যে ২৩ নভেম্বর যে চুক্তি হয়েছে তা যৌক্তিক উপায়ে, আস্থা ও সুপ্রতিবেশীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে বলে ভারত আশা করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবটি সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে না বলে ভোটাভুটি থেকে ভারত বিরত থাকবে।
এরপর ফিলিপাইন প্রস্তাবের বিপক্ষে আর জাপান ও ইকুয়েডর ভোটাভুটি থেকে বিরত থাকার কথা জানায়।
পরে সভাপতি উপস্থিত সদস্যদের ভোটে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান। ভোটের ফলাফলে তিনি জানান, প্রস্তাবের পক্ষে ৩৩টি ও বিপক্ষে ৩টি দেশ ভোট দিয়েছে। ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকেছে ৯টি দেশ।
ভোটের ফলাফলের পর জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি শামীম আহসান অধিবেশনে বলেন, মানবিক ও মানবাধিকার সুরক্ষার এমন একটি প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি হওয়ায় বাংলাদেশ অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছে। কারণ প্রস্তাবটি নৈর্ব্যক্তিকভাবে নেয়া হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়। খসড়া প্রস্তাবটি নিয়ে সদস্যদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল।
সকালে অধিবেশনের উদ্বোধনী পর্বে জাতিসংঘের মানবাধিকার–বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চরম নৃশংসতার জন্য ‘গণহত্যার’ দায়ে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বিচার হতে পারে।
রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ২৬ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে।
গত ২৬ নভেম্বর থেকে ১ হাজার ৬২২ জন রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসার প্রসঙ্গ টেনে জেইদ রাদ আল হুসেইন বলেন, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনে চুক্তি সইয়ের পরও মিয়ানমারের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টির লোকজনের বাংলাদেশে আসা থামেনি।
রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন–পীড়নের ওপর প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে জেইদ রাদ আল হুসেইন বলেন, ‘এতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অত্যাচারের বর্ণনা দেয়া আছে। লোকজনকে জোর করে তাদের বাড়ির মধ্যে আটকে রেখে আগুনে পুড়িয়ে মারা, নির্বিচারে হত্যা, পালাতে থাকা নিরস্ত্র লোকজনের ওপর গুলি, নারী ও মেয়ে শিশুদের গণহারে ধর্ষণ এবং বাড়ি, স্কুল, বাজার ও মসজিদ পুড়িয়ে দেয়া বা ধ্বংস করার কথা এতে রয়েছে। গণহত্যা প্রমাণের জন্য এখানে সম্ভাব্য যেসব উপাদানের কথা উল্লেখ আছে, তা কি আপনারা কেউ উড়িয়ে দিতে পারবেন?’
জেইদ রাদ আল হুসেইন বলেন, রাখাইনে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়মিতভাবে নজরদারি এবং শরণার্থীদের নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তাদের কাউকে দেশে ফেরত পাঠানো উচিত হবে না, এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে স্পষ্ট হতে হবে।
তিনি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নৃশংসতাকে বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাতে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশের অনুরোধ বিবেচনা করার অনুরোধ জানান। প্রস্তাবিত তদন্ত কমিশন জাতিসংঘের বর্তমান সত্যানুসন্ধানী মিশনের সম্পূরক ভূমিকা রাখবে।
জাতিসংঘের নিরপেক্ষ সত্যানুসন্ধানী মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান মালয়েশিয়া থেকে ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘নির্যাতনের প্রমাণ খুঁজতে আমাদের তদন্ত অব্যাহত থাকবে।’
সংঘাতে যৌন সহিংসতার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেন বলেন, ‘শুধু জাতিসত্তা ও ধর্মের কারণে ঠাণ্ডা মাথায় একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কীভাবে যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে, বাংলাদেশ সফরের সময় তার ভয়াবহ বর্ণনা আমাকে শুনতে হয়েছে।’