আমাদের জন্যই বাংলাদেশ আলাদা হয়েছে: শরিফ
শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী ছিলেন না—কিন্তু তাকে সেই পথে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ।
গতকাল পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের পাঞ্জাব হাউসে আইনজীবীদের এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।
বিগত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পাকিস্তানি নীতির সমালোচনা করেন তিনি।
নওয়াজ বলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙালিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল—কিন্তু আমরা তাদের সঙ্গে উপযুক্ত আচরণ করিনি এবং তাদের আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিই।’
পাকিস্তানের তিন বারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ বলেন, ‘বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও সুস্পষ্ট প্রতিবেদন দিয়েছিল বিচারপতি হামুদুর রহমান কমিশন কিন্তু আমরা সেটা পড়েও দেখিনি।’
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা যদি পদক্ষেপ নিতাম তাহলে আজকের পাকিস্তান ভিন্ন হত এবং যে ধরনের খেলা হয়ে থাকে সেগুলো হত না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাকিস্তানের সাবেক ও বর্তমান বিচারব্যবস্থার সমালোচনা করে নওয়াজ বলেন, জটিল এ বিচারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করেছে। তারা স্বৈরশাসনকে বৈধতা দিয়েছে এবং সুবিধাবাদের জন্ম দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘স্বৈরশাসকের বিচার করতে পারে, এমন আদালত পাকিস্তানে কখনোই ছিল না।’
এরপর নিজের বর্তমান অবস্থার বিষয়ে নওয়াজ বলেন, বছরের পর বছর তাকে হয়রানি করা হয়েছে এবং প্রতিবাদী হতে বাধ্য করা হয়েছে।
রাষ্ট্র কর্তৃক তাকে কোণঠাসা করার ঘটনার সঙ্গে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির সঙ্গে মিল আছে বলে মনে করেন তিনি।
নওয়াজ শরিফ বলেন, ‘আমার সঙ্গে এবং পাকিস্তানের সব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যা করা হয়েছে তা ঠিক নয়।’
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের এ ধারার অবসান দাবি করেন নওয়াজ।
তিনি বলেন, পর্দার অন্তরাল থেকে যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত করেছেন তাদের উচিত পাপের জন্য অনুশোচনা করা এবং জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির জের ধরে গত জুলাই মাসে নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য ঘোষণা করে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট।
এরপর পদত্যাগ করেন তিনি— তখন থেকে কয়েকবার তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন।
প্রসঙ্গত: পাকিস্তান মুসলিম লীগের (পিএমএল-এন) নেতা নওয়াজ শরিফ তিনবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কোনোবারই মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। সর্বশেষ গতবছর আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণার পর ২৮ জুলাই পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি।
এর আগে ১৯৯০ ও ১৯৯৭ সালে দুই বার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তারপর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি নওয়াজ। দ্বিতীয়বার সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি দেশান্তরিত হয়েছিলেন। তখন বেশিরভাগ সময় থাকতেন সৌদি আরবে। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ।
তার আগের পাকিস্তানের ১৭ জন প্রধানমন্ত্রীর কেউই তাদের পুরো মেয়াদ কখনও দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।
পাকিস্তানের এই পরিণতির জন্য দেশটির সেনা শাসকদের কৃতকর্মের জন্য বিচারের মুখোমুখি না হওয়াকে কারণ হিসেবে দেখছেন নওয়াজ শরিফ।
এ প্রসঙ্গেও একাত্তরে বাঙালির উপর সংঘটিত নিষ্ঠুরতা এবং তার জন্য কারও শাস্তি না হওয়ার বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে পাকিস্তান সরকার গঠিত হামদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনে একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে দায়ী করে তাদের বিচারের সুপারিশ করা হয়।
পাকিস্তান সে অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থায়ই নেয়নি। একাত্তরে গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাও চায়নি বরং বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
এ বিষয়টি নিয়েও নওয়াজের সর্বশেষ আমলেই দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়।