আয়েনের ‘ফ্যাক্টর’ আসাদ
নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘বহিরাগত’দের আসন হিসেবে এমনিতেই বদনাম আছে রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের। তার ওপর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মেরাজ উদ্দিন মোল্লার ‘বিদ্রোহ’ এ আসনে দলের ভাবমূর্তি খানিকটা হলেও খাটো করেছে।
পবা-মোহনপুর আসনটি তৈরি হয় ২০০৮ সালে। সে সময় ওই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মেরাজ উদ্দিন মোল্লা। কিন্তু বিভিন্ন বির্তকিত কর্মকাণ্ডের কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। আর আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচনের টিকেট পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়েন উদ্দিন। ক্ষোভ সামলাতে না পেরে এ আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী হন মেরাজ মোল্লা। তবে ‘নতুনের জোয়ারে’ প্রথমবারই নির্বাচনী বৈতরণী উতরে একেবারে ‘ঘরের ছেলে’ বনে যান আয়েন উদ্দিন।
গতবারের বিপুল ভোটের জয় এবারও পালে হাওয়া যোগাচ্ছে তার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দল তার হাতেই নৌকার বৈঠা তুলে দেবেন, এমনটাই প্রত্যাশা আয়েন উদ্দিনের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নানা কর্মকাণ্ডে আয়েন উদ্দিনও জড়িয়েছেন বিতর্কে। আয়েন উদ্দিনের ভুলের সুযোগ নিতে চান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ। এলাকায় গণসংযোগ চালাচ্ছেন দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে। যা আয়েন উদ্দিনের জন্য ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবেই ভাবা হচ্ছে।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর স্থানীয় একটি স্কুলের পক্ষ থেকে আয়েন উদ্দিনকে সোনার কোর্টপিন উপহার দেওয়া হয়েছিল। তিনি ওই উপহার ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘যে স্কুলের শিক্ষকরা বেতন পান না, সেই স্কুলের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমি কোনো উপহার নিতে পারি না। আমি রাজনীতিতে এসেছি জনগণের সেবা করার জন্য। সেবা নেওয়ার জন্য নয়।’ সেই আয়েন এখন চাল-চলনে পুরোটাই বদলে গেছেন। ধীরে ধীরে অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িয়ে এখন তিনি অজনপ্রিয় এক নেতা। প্রভাব বিস্তারে তার আছে এলাকাভিত্তিক ক্যাডারবাহিনী। দলে মূল্যায়ন না করায় ত্যাগী নেতাকর্মীরা দূরে সরে গেছেন। দলে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
এসব নিয়ে স্থানীয় ও জেলা শাখার নেতারা তার এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে অভিযোগ করেছেন। ওবায়দুল কাদের রাজশাহী সফরে আসলে দলের এই শীর্ষ নেতার কাছে অভিযোগ করেন তারা।
দলের একাধিক নেতাকর্মী জানান, এমপি আয়েনের দাপটে এখন অস্থির খোদ আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মীরা। কোনো অনুষ্ঠানে তাকে প্রধান অতিথি করা না হলে তার ক্যাডাররা অনুষ্ঠান হতে দেয় না। হামলা চালিয়ে তা পণ্ড করে দেওয়া হয়। গত ৩০ জানুয়ারি রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী সরকারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হামলা চালায় এমপি আয়েনের সমর্থকরা। গত বছরের জুনে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে আচরণ বিধি ভেঙে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের হুমকি দেন এমপি আয়েন। তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দিলে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেন তিনি। গত বছর হত্যা মামলার পলাতক প্রধান আসামিকে সঙ্গে নিয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলেন এমপি আয়েন। তার চাপাচাপিতে নিয়ম ভেঙে রাজশাহী চিনিকলের প্রায় দেড়শ’ টন চিনি দলের নেতাকর্মীদের মাঝে নামেমাত্র দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি নৈশপ্রহরী নিয়োগে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
এমপি আয়েনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ নওহাটা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, ‘এমপি আয়েনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল করায় আমাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা এমপি লীগ করি না, আওয়ামী লীগ করি। কেউ দলে থেকে দলের আরেক নেতাদের ওপর হামলার ইন্ধন দেবে-এটা আমরা মেনে নেবো না। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ ডুবছে।’
এমপি আয়েনের ওই আসনটিতে মনোনয়ন চান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ। জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীকে নিয়ে আসাদ পবা-মোহনপুরে গণসংযোগ করছেন। ফলে আগামী নির্বাচনে আয়েন দলের মনোনয়ন পেলেও আসাদের সমর্থকরা তার পক্ষে নাও থাকতে পারে। যা ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা দেবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, দলের নেতা হিসেবে তিনি ওই আসনটিতে মনোনয়ন প্রত্যাশি। তিনি নৌকার পক্ষে এলাকায় ভোট প্রার্থনা করে গণসংযোগ করেন। এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় এমপি আয়েন উদ্দিন।
তিনি আরও জানান, এমপি হওয়ার পর আয়েন উদ্দিন এলাকায় কী কী বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছেন, সেসব অভিযোগ দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে দিয়েছেন স্থানীয় নেতারা।
তবে এমপি আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘ওবায়দুল কাদেরকে রাজশাহী বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা থেকে শুরু করে বিদায় দেওয়া পর্যন্ত আমার নেতাকর্মীরা ছিল। এসব অভিযোগ হাস্যকর। অভিযোগ থাকলে তিনি (ওবায়দুল কাদের) আমাকে বলতেন। কিছুই তো বলেননি।’
নাম না বললেও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে ইঙ্গিত করে আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘এক নেতা সুযোগ নিতে চান। তিনিই আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করতে তৎপরতা চালাচ্ছেন।’