সাইনবোর্ডে ইংরেজির ব্যবহারে নীরব রাসিক
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও রাজশাহী নগরীতে তা মানা হচ্ছে না। তিন বছর ধরে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) এসব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড ও ব্যানার অপসারণ করার কথা বললেও এখনও সেগুলো বহাল রয়েছে।
নগরী ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকটি মোবাইল কোম্পানিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে বাংলা অক্ষরই নেই। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বাংলা বানানের ভুল ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রগতিশীল নাগরিক সংহতির ব্যানারে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবি তোলা হয়। কিন্তু এই আন্দোলনে তেমন সফলতা পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভাষা সৈনিক মোশাররফ হোসেন আকুঞ্জি বলেন, ‘মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এব্যাপারে অন্যদের বলতে হবে কেন?’
এই আন্দোলনের আরেক সৈনিক রাজশাহীর শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা বলেন, ‘১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনের পর মায়ের ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা পায়। এত বছর পরও আমাদের সামনে বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে বড় করে ইংরেজি অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড দেখছি। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। অথচ আদালতের রায়ে বাংলা লেখার জন্য সুস্পষ্ট করে বলা আছে।’
হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকার সব প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর এটি বাস্তবায়নের জন্য আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ বেধে দিয়েছে ডিএনসিসি।
এই ধরনের পদক্ষেপ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের আছে কি-না জানতে চাইলে রাসিকের সচিব খন্দকার মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা তিন বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলে বিষয়টি আরও গভীরভাবে চলে আসে। এজন্য আমরা ব্যবসায়ী নেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করে সব প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করছি।
তবে রাজশাহীতে অনেক বিদেশি থাকেন কিংবা মাঝেমধ্যে আসেন। তাই তাদের প্রয়োজনে নামফলক, সাইনবোর্ডে ইংরেজি কিংবা ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করলেও যেন বাংলা ভাষা বড় করে লেখা হয়Íসে ব্যাপারটিও গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।’
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ‘এমনিতেই একটি নির্দেশনা আছে, সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে এবং পরবর্তীতে ইংরেজিতে লিখতে হবে। আমাদের যেসব ট্রেড লাইসেন্স আছে, সেগুলোতে আমরা এগুলো বিচার করি। এখন অনেক ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি আছে, তারা আবার ইংলিশকে হাইলাইট করে। এদের নিয়েই সমস্যা। আমরা তো ওইভাবে মনিটরিং করি না। আমাদের ট্রেড লাইসেন্সটা যদি ইংলিশে থাকে, সেটা বাংলায় করে দেই। এটাই আমাদের মূল হাতিয়ার।’
সাইনবোর্ডে বাড়ছে ইংরেজির ব্যবহার
বাংলা ব্যবহারের বাস্তবায়ন নিয়ে সামনে কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে মেয়র বুলবুল আরও বলেন, ‘পরিকল্পনা অবশ্যই আছে। কিন্তু সময়, সুযোগ ও পরিস্থিতি সবকিছু বিচার করেই তো কাজ করতে হয়।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘বাঙালি পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র জাতি যারা নিজের ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। এই রক্ত দেওয়া, জীবন দেওয়াÍএটা যেমন একদিকে আবেগের, অন্যদিকে যুক্তিরও। আন্দোলনে মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয়ে মেতে উঠেছিল। এরপর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনেক সংগ্রাম করলাম। স্বাধীন দেশ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, সংবিধান, ভূ-খণ্ড ও একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পেলাম। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীন রয়ে গেলাম। তার প্রমাণ, কথা বলার সময় যে ভাষার পরিভাষা রয়েছেÍ সেটা বাংলায় ব্যবহার না করে অকারণে ও অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি ভাষার বাক্য ব্যবহার করছি। অফিস-আদালতে বিভিন্ন জায়গায় নির্দেশনা ও ফরম ইংরেজিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে উপস্থিতির খাতা ইংরেজিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের ঘরের দরজায় অকারণে ইংরেজি ব্যবহার করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আদালতের রায় রয়েছে। কিন্তু কার্যকর করার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এবার ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। এটা শুভ উদ্যোগ। আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। প্রায় অর্ধ শতাব্দী সময় ধরে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। এটা দুঃখের ও ক্ষোভের।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘরে বাংলা অভিধান রাখতে হবে। শ্রেণিকক্ষে যখন ছাত্র-ছাত্রীদের হাজিরা খাতায় লিখি, তখন ‘পি’ লিখি না। লিখি ‘উ’। এতে সালাম-বরকত-রফিকের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে পারি। তাদেরকে স্মরণ করতে পারি।’ সূত্র বাংলা ট্রিবিউন