বাংলাদেশ ব্যাংক এডি রেশিও কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েই কিছুটা তারল্য সংকটে পড়ছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এডি রেশিও (ঋণ ও আমানতের অনুপাত) বাস্তবায়ন, কয়েক মাস ধরে আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় গ্রাহকদের অর্থ তুলে নেয়াসহ কয়েকটি কারণে তারল্য সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। ঋণ প্রদানে লাগাম টেনে তারা এখন আমানত বাড়াতে ছুটছে গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে। বিশেষ করে সরকারি অর্থ আমানত রাখতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে ব্যাংকগুলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অথচ কয়েক মাস আগেও এই পরিস্থিতিটা ছিল ঠিক উল্টো। তখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মনোযোগ ছিল ঋণ প্রদানে প্রতিযোগিতা করা। আমানত সংগ্রহে আগ্রহ ছিল কম। ফলে স্প্রেডসীমা (ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ব্যবধান) ৫ শতাংশ থাকার নিয়ম থাকলেও অনেক ব্যাংকেরই এই হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এডি রেশিও কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েই কিছুটা তারল্য সংকটে পড়ছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। তাই সবাই আমানত সংগ্রহে মনোযোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি আমানত সংগ্রহ করাই এখন তাদের মূল লক্ষ্য। তবে শিগগিরই তারল্য বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইন বলেন, ঋণের তুলনায় আমানত কিছুটা কমেছে। তাই সরকারি আমানত থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
সম্প্রতি এডি রেশিও কমিয়ে সাধারণ ব্যাংকের জন্য সর্বোচ্চ ৮৩ দশমিক ৫০ ও ইসলামী ধারার ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা জুনের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অর্থবছরের শুরু থেকেই ঋণ প্রবাহ অনেক বেশি মাত্রায় বাড়তে শুরু করেছে। গড়ে প্রতিমাসে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু আমানত বেড়েছে মাত্র ৯ থেকে ১১ শতাংশ। আমানতের তুলনায় ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ৯ শতাংশ বেশি। এসব কারণে তারল্যে টান পড়ছে।জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আমানত নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ব্যাংকগুলো। আর ব্যাংকগুলোও এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায়। এই জন্য সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ১০ শতাংশ সুদ চায়।
ইতিমধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে আমানত নেয়ার জন্য বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন, ব্র্যাক, দ্য সিটি, সাউথইস্ট, ঢাকা ব্যাংকসহ প্রথম সারির ব্যাংকগুলো দৌড়ঝাঁপ করছে।
গত বুধবার পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলো শুধু সোনালী ব্যাংক থেকেই প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা মেয়াদি আমানত ধার নিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংক মিলিয়ে ধার দেয়া মেয়াদি আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
আমানতের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ হারও বাড়িছে। অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকের ঋণের সুদ হার এখন গড়ে ১৩ শতাংশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ৩ বছর ধরে ধাপে ধাপে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ হার কমিয়েছে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক আমানতের সুদ হার ২ শতাংশে নেমে এসেছিল। এখন আবার আমানতের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় আমানতকারীরা ব্যাংকমুখী হবে।
সাধারণত দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের ৭৫ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে জমা রাখতে হয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। বাকি ২৫ শতাংশ আমানত বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হয়। কিন্তু অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়মের তোয়াক্কা না করে বেসরকারি ব্যাংকে বেশি আমানত রেখেছিল। নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত রেখে বিপদে পড়েছে। তারল্য সংকটে সম্প্রতি জলবায়ু তহবিলের টাকা ফেরত দিতে পারেনি ব্যাংকটি। এমতাবস্থায় বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানত বাড়াবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের মাঝে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতির ৭০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ সরকারি আমানতের মাত্র ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকগুলোতো রাখা হচ্ছে। এই হারকে ৫০ শতাংশ করা দরকার। অথচ উল্টো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ তুলে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারি আমানতের অন্তত অর্ধেক অর্থ পাওয়া গেলে বর্তমান সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এ বিষয়ে সরকারের সাথে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও অনুরোধ করা হয়েছে।
এর আগে ২০১০ সালে ব্যাংকগুলোয় আমানত সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। ওই সময় ব্যাংকগুলো চড়া সুদে আমানত নেওয়ার পাশাপাশি দেড় শতাংশ সুদে কলমানিতেও ধার করেছিল।