বেকারত্বের সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম
‘আজ থেকে সরকারিতে চাকরিতে প্রবেশের সব পথ বন্ধ হয়ে গেল। কী হবে আর এই সনদ, নম্বরপত্র দিয়ে? তোমাদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারার জন্য দুঃখিত। ক্ষমা করে দিও প্রিয় মা-বাবা।’
বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেও কাঙ্ক্ষিত সরকারি চাকরি জুটাতে না পারার হতাশায় চাকরিতে প্রবেশের নির্ধারিত বয়স শেষে নিজের শিক্ষা জীবনের সব সনদের ছবি দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিতে দেখা যায় অনেক শিক্ষিত তরুণকে।
কিন্তু সরকারি চাকরির এত চাহিদার পরেও খালিই পরে আছে বিভিন্ন শ্রেণির তিন লক্ষাধিক পদ। একদিকে লাখ লাখ প্রার্থী চেষ্টা করেও চাকরি পাচ্ছেন না, অপরদিকে ‘যোগ্য লোক না পাওয়ায়’ বছরের পর বছর খালিই থেকে যাচ্ছে লাখ লাখ পদ। এতে বেকার সমস্যা প্রকট যেমন হচ্ছে, তেমনি লোকবলের অভাবে গতি হারাচ্ছে সরকারি দপ্তরগুলো।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার। বেকারত্বের সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। প্রতিবছর ২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে।
বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেছেন, বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাংলাদেশের বিশাল তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃত অর্থে জনসম্পদে রূপান্তর করতে না পারলে আমরা যে ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের অথবা ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি, তা অধরাই রয়ে যাবে।
কিন্তু এত বেকারত্ব সমস্যা থাকলেও কেবল সরকারি চাকরির বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে খালি রয়েছে তিন লক্ষাধিক পদ।
চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে শূন্য পদের সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হজার ২৬১টি। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণির শূন্য পদের সংখ্যা ৪৮ হাজার, ২৪৬টি, দ্বিতীয় শ্রেণির শূন্যপদের সংখ্যা ৫৪ হাজার ২৯৪টি, তৃতীয় শ্রেণির শূন্যপদের সংখ্যা ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৩৭টি এবং চতুর্থ শ্রেণির শূন্যপদ রয়েছে ৭৩ হাজার ৯৮৪টি।
কিন্তু যেকোন সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে প্রতি পদের বিপরীতে আবেদন করছেন হাজার হাজার তরুণ। সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএস’র ২ হাজার ২৮টি পদের বিপরীতে আবেদন করেন ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬৮ জন প্রার্থী ।
নিয়মিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না হওয়া এবং কোটা ব্যবস্থার কারণেই এ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বছরের পর বছর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না হওয়া এবং বিসিএসসহ অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষা নিয়মীত না হওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে, খালি থেকে যাচ্ছে লাখ লাখ পদ।
‘‘তাছাড়া জনপ্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যামান কোটা ব্যবস্থাও অন্যতম কারণ। কারণ কোটার পদগুলো নির্দিষ্ট থাকায় সেখানে মেধা থেকে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে কোটায় নিয়োগের ক্ষেত্রেও পাওয়া যাচ্ছে না যোগ্য প্রার্থী। সবমিলিয়েই এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’’
যেকোন দপ্তরে পদ খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করাসহ প্রতিটি নিয়োগ পরীক্ষা সময়মত গ্রহণ এবং কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসা সম্ভব মনে করেন এ অধ্যাপক।
‘‘একটি অনগ্রসর অংশের জন্য হয়তো কোটা ব্যবস্থা থাকতে পারে, যেমন আদিবাসী, নারী। কিন্তু সেটা অনির্দিষ্ট সময় ধরে চলতে পারে না। কোটা ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। পাশাপাশি এটাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত যে কত বছর ধরে এ কোটা ব্যবস্থা চলবে।’’
বিদ্যমান ব্যবস্থায় সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি কোটা রয়েছে ৫ শতাংশ। এতে মোট ৫৫ শতাংশ নিয়োগ হয় কোটায়। ফলে মেধা তালিকায় শুরুর দিকে থেকে অনেকে বঞ্চিত হলেও কোটা থাকার কারণে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
‘অযৌক্তিক’ কোটা ব্যবস্থার কারণেই জনপ্রশাসনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মত দিয়েছেন সাবেক দুই মন্ত্রীপরিষদ সচিব ড. আকবর আলী খান এবং আলী ইমাম মজুমদারসহ সাবেক শীর্ষ আমলা এবং বুদ্ধিজীবীরা।কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি উঠেছে দেশের সর্বত্রই। গত রোববার দেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ শীর্ষস্থানীয় সরকারি কলেজ এবং জেলা ও বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীরা। একই দাবিতে তারা রোববারও দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।