মুন্সীগন্জ, সদর ও গজারিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনটি ও তাঁর সমীকরন
লিটন মাহমুদ :
জাতীয় সংসদের ১৭৩ নম্বর নির্বাচনী এলাকাটি দীর্ঘদিন বিএনপির দখলে ছিল। নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনটি দখল করে নেয়। পরের সংসদেও ক্ষমতাসীনরা আসনটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
এ কারণে আগামী নির্বাচনে বিএনপির লক্ষ্য স্বাভাবিকভাবেই আসনটি পুনরুদ্ধার করা। তবে এখন পর্যন্ত দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঠপর্যায়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রচারে দেখা যায়নি। তবে জেলা ও উপজেলা সদরে দলটির কেন্দ্র ঘোষিত বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে থাকার চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ আসনটি ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রচারে আছে। দলের বর্তমান ও সাবেক দুই সংসদ সদস্য মনোনয়ন পেতে জোরালোভাবে কাজ করছেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় আছেন আরো অন্তত চারজন। এলাকায় নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনার মূল বিষয় চরাঞ্চলের সংঘাত। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিবেচ্য হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে জোর লড়াই হবে বর্তমান ও সাবেক দুই সংসদ সদস্যের মধ্যে। মাঠপর্যায়ে ঘুরে এবং দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জের চারটি আসনই ছিল বিএনপির দখলে। ২০০৮ সালে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে তিনটি আসন করা হয়। এরপর ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে বিএনপির ঘাঁটি দখল করে নেয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠন করলেও মুন্সীগঞ্জের চারটি আসনেই বিএনপি বিজয়ী হয়েছিল। তবে ২০০৮ সালে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম ইদ্রিস আলী প্রায় ২২ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থী সাবেক তথ্যমন্ত্রী এম শামসুল ইসলামকে পরাজিত করে বিজয়ী হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগ : দশম সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস। তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনেও দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন।
সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি বেশির ভাগ সময় এলাকায় অবস্থান করে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় এলাকায় জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোটারদের দোয়া চেয়ে তাঁর ব্যানার-পোস্টার শোভা পাচ্ছে এখানে।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানায়, নির্বাচনী এলাকাটির চরাঞ্চলের আধিপত্য বিস্তার, মাদক কারবার ও অস্ত্রের ঝনঝনানি স্থানীয় জনমনে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে মৃণাল কান্তির সফলতা নিয়ে। সম্প্রতি চরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দফায় দফায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে এলাকাবাসীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, যা আগামী ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে।
মনোনয়ন বিষয়ে জানতে চাইলে মৃণাল কান্তি দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের প্রধান শেখ হাসিনা। এই বোর্ডই প্রার্থী মনোনয়ন করে। ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের গুরুত্ব দেয়। আমার দক্ষতা, যোগ্যতা, গুণ ও এলাকার জনসমর্থন বিবেচনা করে আমাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার অন্যতম শক্ত দাবিদার বলে মনে করা হচ্ছে সাবেক সংসদ সদস্য এম ইদ্রিস আলী। সাবেক এই প্রতিরক্ষাসচিব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর আমলে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়। অশান্ত চরের জনপদে তিনি শান্তি ফিরিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি এলাকাবাসীর কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন এ কারণে আজও তাঁকে স্মরণ করে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ইদ্রিস আলী বিএনপির তথ্যমন্ত্রী এম শামসুল ইসলামকে পরাজিত করে আসনটি পুনরুদ্ধার করে তাঁক লাগিয়ে দেন। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কারণে দল-মত-নির্বিশেষে সবার গ্রহণযোগ্যতাও অর্জন করেন তিনি। সাফল্যের কারণে দলে অনেকের চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে তাঁকে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দলের প্রধান শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছিলেন তিনি।
দলীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইদ্রিস আলী আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবার মাঠে নেমেছেন। পোস্টার লাগিয়ে এলাকাবাসীর দোয়া চাওয়ার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন এবং জনসংযোগ চালাচ্ছেন।
এম ইদ্রিস আলী সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে নিজেকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘আমার বিকল্প মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে কোনো প্রার্থী নেই।’ ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরে গণসংযোগও করছেন তিনি। জনসমর্থনের বিচারে তিনি অনেক এগিয়ে আছেন বলে দল তাঁকেই মনোনয়ন দিবে বলে তিনি আশাবাদী।
এ প্রসঙ্গে ইদ্রিস আলী বলেন, ‘গত নির্বাচনে আমি মনোনয়ন চাইনি। কারণ সব কিছু আওয়ামী লীগের অনুকূলে ছিল। এবার দেখি সব চিত্র পাল্টে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খুন হচ্ছে দলীয় লোকদের হাতে। যে চরে আমি শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলাম, মাত্র কিছুদিনের মধ্যে ৮০টি মামলা শেষ করে হাজারো লোককে ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম আজ সে চরে অস্ত্রের ঝনঝনানি। চরাঞ্চল মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এসব কারণে এলাকাবাসীর ইচ্ছায় আমি আবারও দলীয় প্রার্থী হতে চাচ্ছি। যদি দল আমাকে মনোনয়ন দেয়, তবে আমি আবশ্যই পাস করব। আর পাস করে চর এলাকাসহ মুন্সীগঞ্জে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে এনে এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখব।’
আওয়ামী লীগ থেকে আরো মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনিস-উজ-জামান, মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ফয়সাল বিপ্লব, মিরকাদিম পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহিন ও গজারিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রেফায়েত উল্লাহ খান তোতা।
শহিদুল ইসলাম শাহিন এর আগে প্রথমবার স্বতন্ত্র ও দ্বিতীয় আওয়ামী লীগের টিকিটে মেয়র নির্বাচিত হন। একাদশ সংসদ নির্বাচন করার ইচ্ছা জানিয়ে তিনি ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার লাগিয়েছেন। ভোটের মাঠে তাঁর বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে বলে মনে করছে অনেকে।
মেয়র শাহিন বলেন, ‘আমার এলকার লোকজন আমাকে এমপি হিসেবে পেতে চায়। তারা আমার কাজে খুশি হয়ে আরো ব্যাপক উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাকে মেয়র থেকে এমপি হিসেবে দেখতে আগ্রহী। তাই জনগণের কথা চিন্তা করে এমপি নির্বাচন করার কথা ভাবছি। আশা করছি, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনিস-উজ-জামান পোস্টার ব্যানার ও ফেস্টুন লাগিয়ে এলাকাবাসীর দোয়া চেয়েছেন। তাঁর পোস্টার-ব্যানার ও ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে মুন্সীগঞ্জ শহর ও আশপাশের এলাকা। তিনি দুইবার বিপুল ভোটে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আনিস-উজ-জামান বর্তমানে দলের জেলা শাখার সহসভাপতি। নির্বাচনী এলাকায় তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাঁর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে।
আনিস-উজ-জামান বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকায় আমার ব্যাপক জনসমর্থন থাকার কারণেই আমি মনোনয়ন পাব বলে আশাবাদী।’
বিএনপি : সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির মুন্সীগঞ্জ জেলা শাখা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুল হাই আগামী নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী। এ ছাড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতনও মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
দলটির নেতাকর্মীরা জানিয়েছে, আব্দুল হাইয়ের মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত। আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
অন্যান্য : জাতীয় পার্টি থেকে দলের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাতেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক দিদার হোসেন মনোনয়ন চাইবেন বলে আলোচনা রয়েছে।