ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ধরলা ও সানিয়াজান নদীর পানিবৃদ্ধি পেয়েছে
আসাদুজ্জামান সাজু, লালমনিরহাট
ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ধরলা ও সানিয়াজান নদীর পানিবৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গত ৪ দিন ধরে লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় বন্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নদী ভাঙন। প্রতি মুহূর্তে বসত-বাড়ি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বৃহস্পতিবার দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ দোয়ানী পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটর। যা নতুন বিপদ সীমার ৫ সেন্টিমিটার উপরে। পূর্বের বিপদ সীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে।
তিস্তা ব্যারাজ বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ভারী বর্ষণের সঙ্গে উজানের পাহাড়ি ঢলে গত ১ জুলাই সকাল থেকে তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ওই দিন বিকেল ৩ টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটার। পর দিন কিছুটা কমে গেলেও ৩ জুলাই সকাল থেকে পানিবৃদ্ধি পেয়ে একই গতিতে বৃহস্পতিবার বিকালে এ পয়েন্টে পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার। এ পয়েন্টের নতুন বিপদ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার। ব্যারাজ রক্ষার্থে প্রায় সব জলকপাট খুলে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। পানিবৃদ্ধির ফলে জেলার পাঁচটি উপজেলার চরাঞ্চলের নিচু এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের মাঝে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবার সংকট দেখা দিলেও এখন পর্যন্ত সরকারি ভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। জেলার আদিতমারী উপজেলার গোবর্দ্ধন সলেডি স্প্যার-২ বাঁধের ভাটিতে মঙ্গলবার দুপুর থেকে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে।
এ দিকে হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী এলাকায় ৫ শতাধিক পরিবার গত ১০ দিন ধরে পানি বন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। এ ছাড়া ওই উপজেলার গড্ডিমারী, সানিয়াজান, সিঙ্গিমারী, সির্ন্দুনা, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবার গত ৫ দিন ধরে পানি বন্দি অবস্থায় পড়ে আছে।
আদিতমারী উপজেলার গোবর্দ্ধন এলাকার স্থানীয় ইউপি সদস্য মতিয়ার রহমান জানান, মঙ্গলবার দুপুরে হঠাৎ ভাঙন দেখা দেয়। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১০টি বসত বাড়ি নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। বাস্তুহারা মানুষগুলো তাদের ঘর বাড়ি বাঁধে ও উচু স্থানে সরিয়ে যাচ্ছে।
গোবর্দ্ধন চরাঞ্চলের মানিক, মজমুল ও আজিজুল ইসলাম জানান, ঘরে হাটু পানি। মাচাংয়ের ওপর চুলা বসিয়ে কোনো রকমে চাল সিদ্ধ খেয়া দিনাতিপাত করছেন তারা। তবে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি বলে তাদের দাবি।
জানা গেছে, বন্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নদী ভাঙন। গত এক সপ্তাহে জেলায় ২ শতাধিক বাড়ি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো। আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড় বালুর বাঁধের প্রায় দুই শত মিটার নদী গর্ভের বিলিন হয়েছে। বাঁধটি রক্ষায় কাজ শুরু করেছে লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ। তারা জরুরি প্রতিরক্ষা প্রকল্পের আওতায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে জিও ব্যাগ ও বাঁশের পাইলিং দিয়ে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাউবো দাবি করেছে এ বাঁধে দুই হাজার ৯৮৬টি জিও ব্যাগ নদীতে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তাদের এ হিসাব মানতে নারাজ স্থানীয়রা। স্থানীয়দের দাবি তিন দফায় আড়াই হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে।
কুটিরপাড় বাঁধের বাসিন্দা সোলেমান আলী, নজরুল ও কলিম মিয়া জানান, শুষ্ক মৌসুমে বাঁধগুলো সংস্কার করলে কাজটা মানসম্মত হতো। কিন্তু তা না করে বর্ষাকালে তাড়াহুড়ো করে নামমাত্র কাজ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় ঠিকাদার ও সরকারি কর্মকর্তারা। এভাবে টাকা খরচ হলেও তাদের কষ্টের সমাপ্তি ঘটে না বলে দাবি করেন তারা।
ওই এলাকার তালেব, সাইদুল ও আলম মিয়া জানান, গত তিন রাত ধরে চোখে ঘুম নেই। রাত জেগে বাঁধ পাহারা দিচ্ছেন। বাড়ির লোকজন পালাক্রমে ঘুমাচ্ছেন। কখন হিং¯্র ¯্রােতে ভেসে যায় বসত বাড়ি ও ফসলি জমি এ আতঙ্কে কাটছে তাদের দিন।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটির চন্ডিমারী স্প্যার থেকে বারঘড়িয়া পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের দাবি জানালেও কোনো কাজে আসেনি। ফলে এ বাঁধটি নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তিস্তা পাড়ের মানুষ। এ বাঁধটি ছিড়ে গেলে উপজেলা শহর এবং লালমনিরহাট জেলা শহরও ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে স্থানীয়দের দাবি।
মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মজমুল হক জানান, গত চলতি সপ্তাহে ২০টিসহ এ ইউনিয়নে এ পর্যন্ত ৪৫টি বসত বাড়ি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। কুটিরপাড় বালুর বাঁধটিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বাঁধটি ভেঙে গেলে আরও প্রায় ১০টি গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়বে।
তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের পানি উন্নয়ন বোডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল আলম চৌধুরী জানান, উজানের ঢলে গত ২৪ ঘণ্টায় বিপদ সীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে তিস্তায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। বর্ষাকালে পানি প্রবাহ এভাবে বাড়া কমার মাঝেই চলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক (ডিসি) শফিউল আরিফ জানান, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোতে কাজ চলমান রয়েছে। আতঙ্কের কিছু নেই। বাঁধ রক্ষায় জরুরিভাবে কোথাও প্রয়োজন পড়লে তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।