বিশ্বের সবচে দীর্ঘজীবী পরুষ এখন ঝিনাইদহের শের আলী মিয়া
জাহিদুর রহমান তারিক,ঝিনাইদহ 4TV
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামে শের আলী মিয়া হাওলাদার (১২৪) নামে দেশের সবচে বয়স্ক পুরুষ মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। ১১৫ বছর পর্যন্ত তিনি মাঠেও কাজ করেছেন। এখনো নিজে ওজু করে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন তিনি। জীবনে কোন অসুখ বিসুখ তাকে স্পর্শ করেনি। জীবন সয়াহ্নে এসেও তিনি এক প্রাণবন্ত মানুষ। শের আলী মিয়া ৭ প্রজন্মকে দেখছেন। তার ছেলে ও মেয়ের সন্তানসহ ৯০ জন বংশধর রয়েছে। বর্তমান তার দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষের ছোট মেয়ে মনোয়ারা বেগমের বয়স ৭০ বছর ও ছোট ছেলে শহিদুল ইসলামের বয়স ৫২ বছর। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বড় মেয়ে আনোয়রা খাতুন জীবিত থাকলে এখন তার বয়স হতো ৮৪ বছর। ২০০৪ সালে ৭৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন আনোয়ারা খাতুন। পরিবারের দাবী শের আলী মিয়াই পৃথিবীর দীর্ঘজীবী পুরুষ মানুষ। জাতীয় পরিচয় পত্রে (আইডি নং ৪৪১১৯৫৮৩৯৪৮৭০) শের আলী মিয়ার জন্ম তারিখ ১৯০৮ সালের ১৭ জুলাই উল্লেখ করা হলেও মিডিয়ার উটকো ঝামেলা থেকে বাঁচতে তার স্কুল শিক্ষক ছেলে আব্দুল হক ভোটার তালিকা করার সময় ১৫ বছর বয়স কমিয়ে দেন। এটা তার পিতার কঠোর নির্দেশ ছিল ছিল বলে জানান আব্দুল হক। পরিবারের দেওয়া তথ্যমতে শের আলী মিয়া জন্ম গ্রহন করেন ১৮৯৪ সালের জুলাই মাসে। আর বাংলা সান ছিল ১৩০০ সালের ভাদ্র মাস। তার পিতার নাম মৃত আমির আলী বক্স। মাতা জয়গুন নেছা ওরফে যমুনা বিবি। আসছে ভাদ্র মাসে শের আলী মিয়ার বয়স ১২৫ বছর পুর্ন হবে বলে জানান তার ছোট ছেলে শহিদুল ইসলাম। বর্তমান তার বয়স ১২৪ বছর। ভাঙ্গা ভাঙ্গা অনেক স্মৃতি রোমন্থন করেন তিনি। ১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন শের আলী মিয়া সবে মাত্র কৈশর থেকে যৌবনে পা রেখেছে। শের আলী ও তার পরিবারের দেওয়া এই তথ্য সঠিক হলে ১২৪ বছর বয়সী শের আলী মিয়াই হবেন পৃথিবীর সবচে দীর্ঘজীবী পুরুষ। যদিও বর্তমান জাপানের ১১২ বছর বয়সী নাগরিক মাসাজো নোনাকা পৃথিবীর সবচাইতে বেশি বয়সী পুরুষ হিসেবে গ্রিনেস বুকে স্থান পেয়েছে। মাসাজো নোনাকার চেয়ে ঝিনাইদহের শের আলী ১২ বছরের বড়। নিজের জন্ম সাল মনে না থাকলেও শের আলী জানালেন, শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার রাহাপাড়া গ্রামে তারা বসবাস করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ভারত বর্ষ থেকে ব্রিটিশরা যখন সৈন্য সংগ্রহ শুরু করে, তখন শের আলী ও তার বড় মামা আমজাদ আলী সরদার যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশ সৈন্যদলে নাম লেখান। সে সময় তারা তাকে একটি সার্টিফিকেটও দেন, যেটি তার ছেলেরা হারিয়ে ফেলেছেন। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তার মা-বাবাসহ বাড়ির সবাই কান্নাকাটি শুরু করেন। যুদ্ধে যাওয়া বাধ্যতামুলক করে ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন জোট ফরমান জারী করলে শের আলী মিয়া ও তার বড় মামা তখন যুদ্ধে না গিয়ে পালিয়ে যান ভারতের বনগাঁর কাঠালিয়া গ্রামে। পরবর্তীতে সপরিবারে ভারতে বসবাস শুরু করেন। ভারত থেকে তিনি প্রায় শরীয়তপুরের রাহাপাড়া গ্রামে আসা যাওয়া করতেন। আনুমানিক ২০/২২ বছর বয়সে তিনি পাশ্ববর্তী নলতা গ্রামের করম আলী খুনকারের মেয়ে আছিয়া খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথম পক্ষের এক কন্যা সন্তান হওয়ার পর স্ত্রীর আর কোন সন্তান হবে না জানতে পেরে তিনি নলতা গ্রামের তমিজ উদ্দীন মাঝির কন্যা রুপভান বেগমকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে তোলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষে ৫ ছেলে ও ১ মেয়ে। ১৯৬৮ সালে ছোট স্ত্রী রুপভান ও ১৯৯৯ সালে বড় স্ত্রী আছিয়া খাতুন ইন্তেকাল করেন। শের আলী মিয়ার ভাষ্যমতে, ১৯৪৬ সালে ভারতে পাঞ্জাবে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে সম্পত্তি বিনিময় করে তিনি ৫ ভাই ও পিতা মাতার সাথে চলে আসেন যশোরের চৌগাছা উপজেলার ভাদড়া গ্রামে। ভাদড়া গ্রামে এসে দেখেন মুসলিমদের নামাজ পড়ার কোন মসজিদ নেই। ১০/১৫ ঘর মানুষের বেশির ভাগ মুসলিম হিন্দু রীতি অনুসরণ করেন। এ সব দেখে তিনি নিজের ইমান আকিদা রক্ষা করতে চলে আসেন ঝিনাইদহের কুলবাড়িয়া গ্রামে। রাস্তাহীন গ্রামে এসে তিনি ও তার ভায়েরা কুড়ে ঘর বেধে বসবাস শুরু করেন। কুলবাড়িয়ার ইয়াকুব আলীর মাধ্যমে জমি কেনেন ৬৫ বিঘা। পিতা সম্পর্কে শের আলী মিয়ার ছেলে স্কুল শিক্ষক আব্দুল হক জানান, তার পিতার বয়স এখন ১২৪ বছর চলছে। দেশে যখন ভোটার তালিকা হয়, তখন পিতার আদেশেই তিনি বয়স কমিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আরো বলেন, তার পিতার বড় মামা আমজাদ সরদার তখনকার সময় শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তার ডায়েরিতেই তার পিতার জন্ম তারিখ লেখা ছিল, যেটি তারা দেখেছেন। বড় ছেলে ফজল মিয়া বলেন, তার পিতা জীবদ্দশায় ৯ বার বাড়ি তৈরী করেছেন। ভারতের কাঠালিয়া, পাচপোতা, যশোরের ভাদড়া, রহমতপুর, বর্তমান গ্রামের তিন স্থানেসহ ৯টি স্থানে ঘরবাড়ি করেছেন। ঘনঘন বাড়ি পরিবর্তনের কারণে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া সেনা রিক্রুটের সনদটি হারিয়ে যায় বলে ফজল মিয়া জানান। ছোট ছেলে শহিদুল ইসলাম জানান, ভোর সকালে ফজরের নামাজ পড়েই বাবা শের আলী মিয়া খেতে চান। সকালে তিনি চিড়ে ও আম খান। এরপর চা খাওয়ার অভ্যাস তার নিয়মিত। দুপুরে যতসামান্য ভাত খান। রাতে ভাতের সাথে দুধ আর মিষ্টি দিতেই হবে। দুধ না দিলে ভাত খান না। রাত জেগে ইবাদত করার অভ্যাস রয়েছে শের আলী মিয়ার। এই বয়সেও তার শরীরে কোন রোগ নেই। চুল দাড়ি অনেকটাই কাচা আছে। জ্ঞান, দৃষ্টি ও শ্রবন শক্তি ভাল থাকায় একাই নিজের কাজ নিজে করতে পারেন। তারপরও ছোট ছেলের স্ত্রী রিপিয়া খাতুন শ্বশুরের দেখভাল করেন সব সময়। এলাকার চেয়ারম্যান খুরশিদ আলম জানান, কুলবাড়িয়া গ্রামের শের আলী মিয়া হতে পারে বিশ্বের সবচে প্রবিণতম পুরুষ। তিনি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে তার বয়স কম দেখানো হয়েছে এটা সত্য। প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধ শের আলীর বয়স অনেক বেশি। মিডিয়াসহ দর্শনার্থীদের ভীড় এড়াতে এই পথ অবলম্বর করেন বলেও চেয়ারম্যান খুরশিদ আলম জানান। আমাদের সম্পর্কে আপনার বার্তা কি? জানতে চাইলে বৃদ্ধ শের আলী মিয়া বলেন, “নামাজ পড়তে হবে, রোজা রাখতে হবে। আর বে-নামাজীর হাতে খাবেন না এই হলো আমার কথা”।