নড়াইলে চুরির অপরাধে কিশোরকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বাঁশকলে ঝুঁলিয়ে ইউপি সদস্যের নির্যাতন
নড়াইল প্রতিনিধি
নড়াইলে চুরির অপবাদ দিয়ে তাহের (১৭) নামের এক হতদরিদ্র কিশোরকে বাঁশকলে ঝুঁলিয়ে এবং ঘরের ঢাবার সঙ্গে বেঁধে লোহার পরিমাপক দিয়ে হাতের তালু ও আঙ্গুলে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে ইউপি সদস্য ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে।
নির্যাতনে গুরুতর আহত ওই কিশোর বর্তমানে নড়াইল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কিশোরের পিতা ওয়াজেদ মোল্যা নড়াইল সদর থানায় মামলা দায়ের করেছেন। তবে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে নির্যাতনকারীরা উল্টো নির্যাতনের শিকার ওই কিশোর ও তার পরিবারের সদস্যদেরকে আসামী করে থানায় চুরির মামলা দায়ের করেছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, নির্যাতিত তাহের সদর উপজেলার তুলরামপুর ইউনিয়নের পেড়লি গ্রামের হতদরিদ্র ওয়াজেদ মোল্যার ছেলে। ওয়াজেদ বিভিন্ন গ্রামে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালায়। মাতা পারভীন বেগম ঢাকার একটি বাসায় ঘর-গৃহস্থলির কাজ করেন। তাদের দুই পুত্র তাহের (১৭) ও লিমন (১১)। শিশু লিমন একই গ্রামের প্রভাবশালী মৃত আকরাম সরদারের পুত্র নাহিদ সরদারের (২৯) বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে।
২৮ জুলাই সকালের দিকে হঠাৎ করেই নাহিদ সরদার ও তার মা শিউলি বেগম তাদের বাড়িতে দুই ভরি ওজনের স্বর্ণের চেইন, কানের দুল এবং নগদ ১০ হাজার টাকা চুরি হয়েছে বলে প্রচার করে।
এ ঘটনায় প্রথমে নাহিদ সরদার লিমনকে চোর সন্দেহ করেন। লিমন অস্বীকার করলে তখন তাকে মারধর করেন তিনি। এরপর প্রাণনাশের ভয় দেখিয়ে বলেন, ‘তোর ভাই তাহের ও চাচাতো ভাই হুমায়ুন এ চুরির সঙ্গে জড়িত। তাই তাদের নাম বল।’ তখন নির্যাতনের ভয়ে তাহের ও হুমায়ুনের নাম জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি করিয়ে নেয় নাহিদ।
ওইদিন সন্ধ্যার দিকে তুলরামপুর ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও প্রভাবশালী নাহিদ সরদার ও তাদের লোকজন তাহেরকে স্বর্ণ ও টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে মারধর শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে নাহিদের পাট রাখার পরিত্যক্ত ঘরে তাহেরকে বাঁশকলে ঝুলিয়ে বেদম প্রহার করে এবং লোহার তৈরি পরিমাপক এবং পেরেক দিয়ে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে নির্যাতন করে। একের পর এক মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের পর ওইদিন রাতে সদর থানার পুলিশের নিকট সোপর্দ করে নাহিদ।
এরপর নাহিদের নির্দেশে থানা হাজতের মধ্যে একটি কক্ষে পুলিশ হেফাজতে কোমরের নীঁচ থেকে পা পর্যন্ত রুল দিয়ে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ ওঠেছে পুলিশেরও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে নির্যাতিত পরিবার। তবে চুরির অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় পরের দিন (২৯ জুলাই) সন্ধ্যার দিকে তাহেরকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। এরপরে নির্যাতনের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে গত ২ আগস্ট রহস্যজনক কারণে চুরির অপরাধে ওই কিশোর ও তার পিতা ওয়াজেদ মোল্যা, ভাই শিশু লিমন হোসেন ও চাচাতো ভাই হুমায়ুনের বিরুদ্ধে আবার চুরির মামলা নিয়েছে পুলিশ।
অপরদিকে, নির্যাতিত তাহেরের পিতা ওয়াজেদ মোল্যা বাদী হয়ে একই দিনে ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও প্রভাবশালী নাহিদ সরদারের নাম উল্লেখসহ মোট ১০ জনকে আসামী করে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। বর্বোরোচিত এ নির্যাতনের ঘটনায় স্থানীয় সচেতন মহলে নিন্দার ঝড় ওঠেছে।
পেড়লি গ্রামের সাইদুর রহমান জানান, ‘নির্যাতনের শিকার তাহের দুই দিন অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে পড়ে ছিল। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে এভাবে মারধর করা হয়েছে। ঘটনার সময় তার মা ও বাবা বাড়িতে ছিল না। নির্যাতনে তাহেরের অবস্থা খারাপ হয়ায় গত ১ আগস্ট নড়াইল সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘নির্যাতনের বিষয়টি গ্রামের প্রায় সব মানুষ জানেন। তবে নির্যাতনকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
অভিযুক্ত তুলারামপুর ইউপি সদস্য দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদ এ বিষয়টি আমাকে বলার পর নাহিদের বাড়িতে যাই। তাহেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেয়। পরে আমি সেখান থেকে চলে আসি। তাহেরকে কারা মারধর করেছে আমি তা বলতে পারব না।’
অপর অভিযুক্ত নাহিদ সরদার সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘তাহের ও লিমন দুই ভাই স্বর্ণ ও টাকা চুরির সঙ্গে জড়িত। তারা পুলিশের নিকট স্বীকারও করেছে। ওদেরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর আমরা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছি। তাহের, তার পরিবার এবং গ্রামের কিছু লোক শত্রুতামূলকভাবে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে।’
এ প্রসঙ্গে নড়াইল সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. অনোয়ার হোসেন জানান, ‘ নির্যাতন ও চুরির উভয় ঘটনায় থানায় একইদিনে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন। এখানে থানা হাজতে পুলিশ কর্তৃক তাহেরকে কোন নির্যাতন করা হয়নি।’